Thursday, July 30, 2015

স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বিবিধ প্রশ্ন-উত্তর

স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বিবিধ প্রশ্ন-উত্তর

                                                                      
স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বিবিধ প্রশ্ন-উত্তর
  
                                                           স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বিবিধ প্রশ্ন-উত্তর

নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য; আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাঁর নিকট তাওবা করি; আর আমাদের নফসের জন্য ক্ষতিকর এমন সকল খারাপি এবং আমাদের সকল প্রকার মন্দ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।


অতঃপর
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য লেনদেনের ব্যাপারে ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক সুস্পষ্ট পরিপূর্ণ নিয়ম-পদ্ধতি বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন, অন্য কোন ব্যবস্থা বা পদ্ধতিই তার সমকক্ষ হবে না; আর লেনদেনের ক্ষেত্রে যদি তা সুদের সাথে সম্পৃক্ত হয়, তাহলে তা হবে যুলুম এবং ন্যায় ও সঠিক পথ থেকে দূরে সরে যাওয়ার অন্তর্ভুক্ত; যে সুদ থেকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবের মধ্যে এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষায় সতর্ক করে দিয়েছেন; আর সকল মুসলিম তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।


আল্লাহ তা‘আলা তাঁর যেই কিতাবটি মানবজাতির প্রতি অবতীর্ণ করেছেন যাতে তারা তাকে তাদের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার ব্যাপারে ফায়সালাকারীরূপে গ্রহণ করে, সেই কিতাবটির মধ্যে বলেছেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَذَرُواْ مَا بَقِيَ مِنَ ٱلرِّبَوٰٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٢٧٨ فَإِن لَّمۡ تَفۡعَلُواْ فَأۡذَنُواْ بِحَرۡبٖ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۖ وَإِن تُبۡتُمۡ فَلَكُمۡ رُءُوسُ أَمۡوَٰلِكُمۡ لَا تَظۡلِمُونَ وَلَا تُظۡلَمُونَ ٢٧٩ ﴾ [البقرة: ٢٧٨، ٢٧٩]
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও যদি তোমরা মুমিন হও। অতঃপর যদি তোমরা না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও। আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই; তোমরা যুলুম করবে না এবং তোমাদের উপরও যুলুম করা হবে না।”[1]

তিনি আরও বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُواْ ٱلرِّبَوٰٓاْ أَضۡعَٰفٗا مُّضَٰعَفَةٗۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ١٣٠ وَٱتَّقُواْ ٱلنَّارَ ٱلَّتِيٓ أُعِدَّتۡ لِلۡكَٰفِرِينَ ١٣١ وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ١٣٢ ﴾ [ال عمران: ١٣٠، ١٣٢]
“হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। আর তোমরা সে আগুন থেকে বেঁচে থাক, যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আর তোমরা আল্লাহর ও রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা কৃপা লাভ করতে পার।”[2]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ ٱلَّذِينَ يَأۡكُلُونَ ٱلرِّبَوٰاْ لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ ٱلَّذِي يَتَخَبَّطُهُ ٱلشَّيۡطَٰنُ مِنَ ٱلۡمَسِّۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ قَالُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡبَيۡعُ مِثۡلُ ٱلرِّبَوٰاْۗ وَأَحَلَّ ٱللَّهُ ٱلۡبَيۡعَ وَحَرَّمَ ٱلرِّبَوٰاْۚ فَمَن جَآءَهُۥ مَوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّهِۦ فَٱنتَهَىٰ فَلَهُۥ مَا سَلَفَ وَأَمۡرُهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِۖ وَمَنۡ عَادَ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٢٧٥ يَمۡحَقُ ٱللَّهُ ٱلرِّبَوٰاْ وَيُرۡبِي ٱلصَّدَقَٰتِۗ وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ ٢٧٦ ﴾ [البقرة: ٢٧٥، ٢٧٦]
“যারা সুদ খায় তারা তার ন্যায় দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, ‘ক্রয়-বিক্রয় তো সূদেরই মত’। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন। অতএব, যার নিকট তার রব-এর পক্ষ হতে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, তাহলে অতীতে যা হয়েছে তা তারই; এবং তার ব্যাপার আল্লাহর ইখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় আরম্ভ করবে তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আর আল্লাহ অধিক কুফরকারী কোন পাপী ব্যক্তিকে ভালবাসেন না।”[3]
আর সহীহ মুসলিমের মধ্যে হাদিস বর্ণিত আছে, জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
« لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم آكِلَ الرِّبَا , وَمُوكِلَهُ , وَكَاتِبَهُ , وَشَاهِدَيْهِ , وَقَالَ : هُمْ سَوَاءٌ » . ( رواه مسلم ) .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ গ্রহিতা, সুদ দাতা, সুদের লেখক এবং সুদের সাক্ষীদ্বয়ের উপর অভিশাপ দিয়েছেন এবং তিনি বলেছেন: তারা সকলেই সমান (অপরাধী)।”[4]
আর ‘লানত’ (অভিশাপ) মানে: আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়িত করা ও দূরে সরিয়ে রাখা; আল্লাহ তা‘আলা জিন ও মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধি ও বোধশক্তি দিয়েছেন; আর তিনি তাদের মাঝে পাঠিয়েছেন রাসূলগণকে এবং তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন ভয়-ভীতি, যাতে তারা তাঁর দাসত্ব করতে পারে এবং তাদের প্রবৃত্তির দাবিকে উপেক্ষা করে তাঁর ও তাঁর রাসূলের আদেশ-নির্দেশকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেদেরকে তাঁর আনুগত্যের অধীন করে নেয়; কারণ, এটাই হল আল্লাহ ‘ইবাদত তথা দাসত্বের বাস্তব চিত্র এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার প্রতি ঈমানের দাবি; যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٖ وَلَا مُؤۡمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمۡرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُ مِنۡ أَمۡرِهِمۡۗ وَمَن يَعۡصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلَٰلٗا مُّبِينٗا ٣٦ ﴾ [الاحزاب: ٣٦]
“আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ের ফয়সালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য সে বিষয়ে তাদের কোন (ভিন্ন সিদ্ধান্তের) ইখতিয়ার সংগত নয়। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল, সে স্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট হলো।”[5]
সুতরাং যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সে বিষয়ে কোনো সত্যিকার মুমিনের জন্য মানা না মানার ইখতিয়ার বা স্বাধীনতা নেই এবং তার সামনে তা সন্তুষ্ট চিত্তে পরিপূর্ণভাবে মেনে নেয়া ছাড়া ভিন্ন কোন পথও নেই, চাই তা তার প্রবৃত্তির চাহিদা মাফিক হউক, অথবা তা তার প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যাক; এর ব্যতিক্রম হলে সে মুমিন নয়; যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥ ﴾ [النساء: ٦٥]
“কিন্তু না, আপনার রবের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।”[6]
যখন এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল, তখন জেনে রাখুন যে, আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশসমূহ দুই ভাগে বিভক্ত:
এক প্রকার নির্দেশ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সাথে সম্পর্ক ও আচার-আচরণ সংশ্লিষ্ট, যেমন: পবিত্রতা অর্জন করা, সালাত, সাওম ও হাজ্জ; আর এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদত হওয়ার ব্যাপারে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে না; আর অপর প্রকার নির্দেশটি সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক ও আচার-আচরণ সংশ্লিষ্ট; আর তা হল তাদের মধ্যকার প্রচলিত ক্রয়, বিক্রয়, ইজারা, বন্ধক ইত্যাদি ধরনের লেনদেনসমূহ। আর যেমনিভাবে প্রথম প্রকারের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশসমূহ বাস্তবায়ন করা এবং তাঁর শরী‘য়তকে যথাযথরূপে গ্রহণ করা প্রত্যেকের জন্য একটি আবশ্যকীয় সর্বজনবিদিত বিষয়; ঠিক অনুরূপভাবে দ্বিতীয় প্রকারের ক্ষেত্রেও তাঁর নির্দেশসমূহ বাস্তবায়ন করা এবং তাঁর শরী‘য়তকে যথাযথরূপে গ্রহণ করা একটি আবশ্যকীয় (ফরয) বিষয়; কারণ, প্রত্যেকটিই আল্লাহ তা‘আলার বান্দাগণের প্রতি তাঁর হুকুম বা নির্দেশ; সুতরাং এ ক্ষেত্রে এবং ঐ ক্ষেত্রে— সকল ক্ষেত্রেই আল্লাহ তা‘আলার হুকুম বাস্তবায়ন ও তাঁর শরী‘য়তকে যথাযথরূপে গ্রহণ করা প্রত্যেক মুমিনের উপর আবশ্যক।
অতঃপর...,
এগুলো হচ্ছে স্বর্ণ[7] বিক্রয়, ক্রয় ও ব্যবহারের বিষয়ে আমাদের শাইখ মুহাম্মদ ইবন সালেহ আল-‘উসাইমীনের নিকট করা কিছু প্রশ্ন, তিনি এগুলোর জওয়াব দিয়েছেন আল্লাহ তা‘আলার নিকট এ প্রত্যাশা যে, যে ব্যক্তি তা পাঠ করে অথবা তা শ্রবণ করে, তিনি যেন তাকে উপকৃত করেন এবং যিনি তা লেখেন অথবা মুদ্রণ করেন অথবা প্রকাশ করেন অথবা তার সাথে সংশ্লিষ্ট কোন কাজ করেন, তিনি যেন তাকে বড় ধরনের পুরস্কার ও সাওয়াব দান করেন; আর তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং উত্তম অভিভাবক।
* * *

প্রথম প্রশ্ন: অনেক স্বর্ণের দোকানদার ব্যবহৃত (ভাঙ্গাচূরা) স্বর্ণ ক্রয়ের কারবার করে, অতঃপর তা নিয়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ীর নিকটে যায় এবং সমাস সমান ওজনে তৈরি করা নতুন স্বর্ণের দ্বারা তা পরিবর্তন করে নেয়, আর সাথে তারা নতুন স্বর্ণের জন্য তৈরি বাবদ বাড়তি পারিশ্রমিক গ্রহণ করে— এমতাবস্থায় এর বিধান কী হবে?
উত্তর:
بسم الله الرحمن الرحيم و الحمد لله رب العالمين و الصلاة و السلام على نبينا محمد و على آله و أصحابه أجمعين .
(রহমান, রহীম আল্লাহর নামে; আর সকল প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য; আর সালাত ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর প্রতি)।
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিস বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন:
« الذَّهَبُ بِالذَّهَبِ وَالْفِضَّةُ بِالْفِضَّةِ وَالْبُرُّ بِالْبُرِّ وَالشَّعِيرُ بِالشَّعِيرِ وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ مِثْلاً بِمِثْلٍ سَوَاءً بِسَوَاءٍ يَدًا بِيَدٍ » . ( رواه مسلم ) .
“স্বর্ণ স্বর্ণের বিনিময়ে, রৌপ্য রৌপ্যের বিনিময়ে, গম গমের বিনিময়ে, যব যবের বিনিময়ে, খেজুর খেজুরের বিনিময়ে এবং লবন লবনের বিনিময়ে লেনদেন সমান সমান ও নগদ নগদ হতে হবে।”[8]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আরও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন:
« مَنْ زَادَ أَوِ اسْتَزَادَ فَقَدْ أَرْبَى » . ( رواه مسلم ) .
“যে ব্যক্তি তার অতিরিক্ত কিছু দিবে অথবা অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করবে, তবে তা সুদ হবে।”[9]
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও হাদিস বর্ণিত আছে যে, তাঁর নিকট উৎকৃষ্ট মানের খেজুর নিয়ে আসা হলে তিনি সেই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন, তখন জবাবে সাহাবীগণ বলেন: “আমরা দুই সা‘ খেজুরের বিনিময়ে এ উৎকৃষ্ট মানের এক সা‘ এবং তিন সা‘য়ের বিনিময়ে দুই সা‘ খেজুর ক্রয় করে থাকি।” তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরেনের কেনাবেচাকে পরিহার করার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় নির্ভেজাল সুদ। অতঃপর তিনি তাঁদেরকে নির্দেশনা প্রদান করে বলেন, তাঁরা যেন নিম্ন মানের খেজুর বিক্রয় করে দেয়, তারপর সেই বিক্রয়লব্ধ দিরহাম দিয়ে উৎকৃষ্ট মানের খেজুর ক্রয় করে।”[10]
এসব হাদিস থেকে আমরা এটা গ্রহণ করতে পারি যে, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ পরিবর্তনের পর যে কোনো একটির সাথে (গহনা বানানো বাবদ) অতিরিক্ত মজুরি ধার্য করার ব্যাপারে প্রশ্নকর্তা যা উল্লেখ করেছেন, তা একটি হারাম লেনদেন তথা অবৈধ এবং সুদের অন্তর্ভুক্ত, যা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন।
তাই এ ব্যাপারে সঠিক পদ্ধতি হল: কোনো প্রকার পূর্ব চুক্তি ব্যতীত ভিন্ন জাতের কোনো মুদ্রার মূল্যের বিনিময়ে ভাঙ্গাচুরা পুরাতন স্বর্ণ বিক্রয় করা এবং স্বর্ণের মালিক কর্তৃক মূল্য গ্রহণ করার পর নতুন জিনিস ক্রয় করা। আর সবচেয়ে উত্তম হল অন্য দোকানে গিয়ে নতুন জিনিস অনুসন্ধান করা; তারপর যদি তা না পাওয়া যায়, তাহলে যার নিকট সে স্বর্ণ বিক্রয় করেছিল তার নিকট ফিরে আসবে এবং দিরহাম তথা প্রচলিত মুদ্রার মাধ্যমে তা ক্রয় করবে; আর এ অবস্থায় যদি দিরহামের পরিমাণ বেশি হয়, তাহলে স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণের লেনদেন না হওয়ার কারণে তাতে কোনও প্রকার সমস্যা নেই; আর যদি দোকানদার নিজেই স্বর্ণকার হয়, তাহলে তার (বিক্রেতার) জন্য এ কথা বলার সুযোগ রয়েছে যে, তুমি এ স্বর্ণ গ্রহণ কর এবং তা দিয়ে আমার জন্য পছন্দসই অলংকার তৈরি করে দাও; আর যখন অলংকার তৈরির কাজ শেষ হবে, তখন আমি তোমাকে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দেব; আর তাতেও কোনো প্রকার অসুবিধা নেই।
* * *

দ্বিতীয় প্রশ্ন: কোনো কোনো স্বর্ণের দোকানদার যারা তাদের নিকট থেকে ক্রয় করতে আগ্রহী এমন গ্রাহকের নিকট থেকে ব্যবহৃত স্বর্ণের বিনিমেয়ে তাদের নিকট রক্ষিত নতুন স্বর্ণের বদ-বদল করে থাকেন এবং তার উপর তৈরি বাবদ বাড়তি পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন— এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
উত্তর:
আমার নিকট এ প্রশ্ন এবং তার পূর্বের প্রশ্নের মধ্যে আলাদা কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না; সুতরাং উভয় প্রশ্নের ব্যাপারে একই হুকুম।
* * *

তৃতীয় প্রশ্ন: কোনো কোনো স্বর্ণের দোকানদার বাকিতে স্বর্ণ ক্রয় করে এমন বিশ্বাসে যে, এটা বৈধ এবং তাদের যুক্তি হল— এটা ব্যবসার পণ্যসামগ্রীর অন্তর্ভুক্ত, অথচ এ ব্যাপারে তাদের বড় বড় ব্যবসায়ীদের সাথে যখন পেশ করা হলো যে, এ ধরনের কারবার বৈধ নয়; তখন তারা বলে যে, এ ধরনের লেনদেন বা কারবারের ব্যাপারে আলেমগণের জানা নেই।
উত্তর:
নিশ্চয় এটি অর্থাৎ দিরহাম তথা মুদ্রার বিনিময়ে বাকিতে স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় করা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম; কারণ, তা ‘রিবায়ে নাসিয়া’ বা বিলম্বজনিত সুদ; আর ‘উবাদা ইবন সামিত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« الذَّهَبُ بِالذَّهَبِ , وَالْفِضَّةُ بِالْفِضَّةِ , وَالْبُرُّ بِالْبُرِّ , وَالشَّعِيرُ بِالشَّعِيرِ , وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ , وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ مِثْلاً بِمِثْلٍ سَوَاءً بِسَوَاءٍ يَدًا بِيَدٍ , فَإِذَا اخْتَلَفَتْ هَذِهِ الأَصْنَافُ فَبِيعُوا كَيْفَ شِئْتُمْ إِذَا كَانَ يَدًا بِيَدٍ » . ( رواه مسلم ) .
“স্বর্ণ স্বর্ণের বিনিময়ে, রৌপ্য রৌপ্যের বিনিময়ে, গম গমের বিনিময়ে, যব যবের বিনিময়ে, খেজুর খেজুরের বিনিময়ে এবং লবন লবনের বিনিময়ে লেনদেন সমান সমান ও নগদ নগদ হতে হবে; তবে এ জাতীয় দ্রব্যগুলোর বিনিময় যখন একটা অপরটার সাথে হবে (অর্থাৎ পণ্য যখন এক জাতীয় না হয়ে ভিন্ন রকমের হবে), তখন তোমরা যেভাবে খুশি বিক্রয় করতে পারবে, যদি তা হাতে হাতে তথা নগদ নগদ হয়।”[11]
এভাবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন।
‘আলেমগণ এ ব্যাপারে জানে না’— তার এ উক্তিটি আলেমগণের উপর এক প্রকার অপবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়; কারণ, ঐ ব্যক্তি তো নিজেই আলেমদেরকে ‘আহলুল ‘ইলম’ ( أهل العلم ) তথা ‘বিজ্ঞজন’ বলে আখ্যায়িত করেছে; আর ‘ইলম ( العلم ) তথা জ্ঞান শব্দটি ‘জাহল’ ( الجهل ) তথা মূর্খতা শব্দের বিপরীত; সুতরাং তারা যদি না জানেন, তাহলে তাদেরকে ‘আহলুল ‘ইলম’ ( أهل العلم ) বলে নামকরণ করাটা শুদ্ধ হয় না; অথচ তাঁরা আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করা বিধানের সীমা-পরিসীমা সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন এবং তারা জানেন ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের কারবার একটি নিষিদ্ধ কারবার, যা হারাম হওয়ার ব্যাপারে শরী‘য়তের স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
* * *

চতুর্থ প্রশ্ন: কোন কোন স্বর্ণের দোকানদার ব্যবহৃত স্বর্ণের বিক্রেতার উপর তার নিকট থেকে নতুন স্বর্ণ ক্রয় করার জন্য শর্তারোপ করে— এ ক্ষেত্রে হুকুম কী?
উত্তর:
এই ধরনের শর্তারোপ করাও বৈধ নয়; কারণ, এটা কম-বেশি করে স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণের ক্রয়-বিক্রয় করার একটা হীন কৌশল; আর এ ধরনের অপকৌশল ইসলামী শরী‘য়তে নিষিদ্ধ; কেননা, তা এক ধরনের প্রতারণা এবং আল্লাহ তা‘আলার বিধানাবলীর সাথে খেল-তামাশা করা।
* * *

পঞ্চম প্রশ্ন: কোনো স্বর্ণকার অপর কোনো স্বর্ণকারের কাছ থেকে বিক্রির জন্য স্বর্ণ নিয়ে আসলে সেখানে কি তাকে শব্দ উচ্চারণ করে ওকীল বানাতে হবে? নাকি তাদের মধ্যে প্রচলিত নিয়মে এটা থাকাই যথেষ্ট যে লোকটি তার কাছ থেকে যা গ্রহণ করেছে তা জানা দরেই বিক্রয় করবে?
উত্তর:
ওকীল বা প্রতিনিধি বানানো এমন একটি চুক্তি যা বুঝা যায় এমন প্রত্যেক কথা ও কাজ দ্বারা সংঘটিত হয়। সুতরাং যখন দোকানদারগণের মাঝে স্বাভাবিকভাবে প্রচলন থাকে যে, যখন তাদের কারও নিকট ক্রেতা গিয়ে দাঁড়ায় এবং তার নিকট কাঙ্খিত পণ্যটি পাওয়া না যায়, তখন সে তার পাশের দোকানে যায় এবং তার নিকট থেকে পণ্যটি এ শর্তে গ্রহণ করে যে, সে তার পণ্যটি বিক্রয় করে দিবে, আর এমতাবস্থায় গৃহীত পণ্যটির মূল্য নির্ধারণ করা থাকবে এবং সে পণ্যের মালিকের পক্ষে তা উভয়ের মধ্যকার নির্ধারণ করা মূল্যে বিক্রয় করে দিল; সুতরাং এ ধরনের চুক্তিতে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ, ওকীল বা প্রতিনিধি বানানোর ব্যাপারে আলেমগণ বলেন যে, এটি এমন একটি চুক্তি যা বুঝা যায় এমন প্রত্যেক কথা ও কাজ দ্বারা সংঘটিত হয়।
* * *

ষষ্ঠ প্রশ্ন: সেই ক্ষেত্রে কী বিধান হবে— যখন কোনো ক্রেতা এসে (কোনো দোকান থেকে) স্বর্ণের পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে, অতঃপর শর্ত করে যে, যদি তা ভালো না হয়, তাহলে সে পরিবর্তন করার জন্য অথবা তার মূল্য ফেরত নেওয়ার জন্য তা দোকানে ফিরিয়ে দিবে? আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে শরী‘য়তসম্মত পদ্ধতি কী হবে— যেখানে কোনো কোনো ব্যক্তি শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করার কারণে তার পক্ষে ঐ দিনে অথবা দ্বিতীয় দিনে দোকানে পুনরায় ফিরে আসা অসম্ভব হয়ে উঠে?
উত্তর:
এইরূপ পরিস্থিতিতে তার জন্য সবচেয়ে উত্তম ও সুন্দর পদ্ধতি হল চুক্তি সম্পন্ন করার আগেই স্বর্ণের পণ্যদ্রব্য নিয়ে তার পরিবারের নিকট চলে যাওয়া; অতঃপর যদি তা পছন্দ হয়, তাহলে সে দোকানদারের নিকট ফিরে আসবে এবং তার সাথে নতুন করে ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করবে, আর এটাই হল সবচেয়ে উত্তম।
তবে যখন সে দোকানদারের নিকট থেকে তা ক্রয় করে এবং চুক্তি সম্পন্ন করে, তারপর সে তার জন্য ‘খিয়ার’ (পছন্দের স্বাধীনতা)-এর শর্ত করল, যদি তা তার পরিবারের পছন্দসই হয়, তাহলে তো কোনো সমস্যাই নেই; আর যদি পছন্দ না হয়, তাহলে তা ফেরত দিবে— তখন এ ব্যাপারে আলেমদের মাঝে মতবিরোধ দেখা যায়; তাঁদের কেউ কেউ এটাকে বৈধ মনে করেন এবং তার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয় মুসলিমগণ তাদের শর্ত অনুযায়ী কাজ-কারবার করবে’। আবার তাঁদের কেউ কেউ এটাকে অবৈধ মনে করেন এবং তার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, এটা এমন শর্ত যা হারামকে হালাল করে দেয়, আর তা হলো, চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই অনিবার্যভাবে (ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে) পৃথকীকরণ করা। প্রথম মতটি শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যার মত বলে সাধারণভাবে প্রতীয়মান হয়। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় মতটি হাম্বলী মাযহাবের মত হিসেবে প্রসিদ্ধ। কারণ তাদের নিকট এমন প্রত্যেকটি চুক্তি, যার মধ্যে পারস্পরিক কবজাকরণ বা দখল নেয়ার শর্ত রয়েছে তাতে ‘খিয়ার’ (পছন্দের স্বাধীনতা)-এর শর্ত করা ঠিক নয়।
আর এর উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, যে ব্যক্তি নিজেকে নিরাপদ ও দায়মুক্ত রাখতে চাইবে সে যেন প্রথম পদ্ধতিটি অনুসরণ করে— অর্থাৎ সে তা গ্রহণ করবে এবং চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই তার ব্যাপারে পরামর্শ করবে।
* ‘চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে’ এর অর্থ কী?
অর্থাৎ সে তাদেরকে বন্ধক হিসেবে কিছু মুদ্রা প্রদান করবে অথবা তার পক্ষ থেকে এমন কোনো পণ্য হস্তান্তর করবে, যাতে তারা এর মাধ্যমে তাকে (সম্পদ ফেরৎপাওয়ার ব্যাপারে) বিশ্বাস করতে পারে, এ অর্থে নয় যে, সে যা প্রদান করছে তা ঐ স্বর্ণের মূল্য, যা সে ক্রয় করতে যাচ্ছে।
* * *

সপ্তম প্রশ্ন: সেই ক্ষেত্রে কী বিধান হবে— কোনো কোনো স্বর্ণের দোকানদার ব্যবহার করা সোনা চকচকে থাকলে তা ক্রয় করার পর নতুন সোনার মূল্যে বিক্রি করার জন্য পেশ করে। এ জাতীয় বিক্রয় বৈধ হবে কি; নাকি ক্রেতাকে তা ব্যবহৃত বলে জানিয়ে দেওয়াটা জরুরি হবে; কিংবা তাকে অবহিত করার প্রয়োজন হবে না। কারণ ক্রেতাদের কেউ কেউ এ কথা জিজ্ঞাসা করে না যে, সেটা নতুন না পুরাতন?
উত্তর:
এ অবস্থায় বিক্রেতার জন্য আবশ্যক হলো, কল্যাণকামী হওয়া এবং নিজের জন্য যা ভাল মনে করে তার ভাইয়ের জন্যও তাই ভাল মনে করা। আর এটা সর্বজন বিদিত যে, যদি কোনো ব্যক্তি তোমার নিকট এমন কোনো জিনিস বিক্রি করল, যা হালকাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং তাতে ব্যবহারের কোন চিহ্ন পড়েনি, আর সে তোমার কাছে তা নতুন বলে বিক্রি করেছে, তাহলে তুমি নিঃসন্দেহে এটাকে তার পক্ষ থেকে প্রতারণা ও ধোকাবাজি বলে গণ্য করবে; সুতরাং তুমি যখন পছন্দ কর না যে, জনগণ তোমার সাথে এ ধরনের আচরণ করুক, তখন কিভাবে তোমার জন্য মানানসই হবে যে, তুমি অন্যের সাথে এ ধরনের (প্রতারণামূলক) আচরণ করবে; আর এর উপর ভিত্তি করেই কোনো মানুষের জন্য এ ধরনের কাজ করা ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ হবে না, যতক্ষণ না সে ক্রেতাকে বিষয়টি স্পষ্ট না করবে এবং তাকে বলে দিবে যে, এ জিনিসটি হালকা ব্যবহার করা হয়েছে অথবা এ ধরনের কিছু।
* * *

অষ্টম প্রশ্ন: কোন ব্যক্তি স্বর্ণের কারখানায় গহনা তৈরির জন্য তার স্বর্ণ হস্তান্তর করে, তারপর কখনও কখনও কারখানায় স্বর্ণ গলানোর সময় তার স্বর্ণ অন্যের স্বর্ণের সাথে মিশে যায়, কিন্তু কারখানা থেকে মালিকপক্ষ তার নিকট তা (গহনা) হস্তান্তর করার সময় তার দেয়া স্বর্ণের সম ওজনেই হস্তান্তর করে— এমতাবস্থায় তার বিধান কী হবে?
উত্তর:
কারখানার কারিগরের উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হল মানুষের সম্পদসমূহের ক্ষেত্রে একজনের সম্পদ অপরজনের সম্পদের সাথে মিশ্রিত না করা, যখন স্বর্ণের মান বিভিন্ন রকম হয়, তখন প্রত্যেকটিকে পৃথক পৃথক করে রাখা। আর যখন যখন স্বর্ণের মান বিভিন্ন রকম না হয়ে একই মানের হয়, তখন এ ধরনের মিশ্রণে কোন সমস্যা নেই; কেননা, তাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
প্রশ্ন: স্বর্ণ হস্তান্তর করার সময় গহনা তৈরির মজুরি দিয়ে দেওয়া কি জরুরি, নাকি আমরা চলমান প্রক্রিয়ায় পরেও তা আদায় করতে পারব?
উত্তর: মজুরি তখনই দিয়ে দেওয়া জরুরি নয়; কারণ, এ পারিশ্রমিক তো কাজের উপর নির্ভর করবে (স্বর্ণের সাথে নয়)। সুতরাং মজুরি যদি গহনা গ্রহণ করার সময় প্রদান করে, তাহলে তা ভালো, নতুবা পরবর্তীতে প্রদান করলেও তা শুদ্ধ হবে।
* * *

নবম প্রশ্ন: যখন কোন কোন স্বর্ণ ক্রয়কারী ব্যক্তি নতুন স্বর্ণের মূল্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, অতঃপর যখন তার মূল্য সম্পর্কে জানতে পারে, তখন দাঁড়িয়ে তার নিকটে থাকা ব্যবহৃত স্বর্ণ বের করে এবং তা বিক্রি করে দেয়; আর তাকে দিরহাম বা প্রচলিত মুদ্রায় তার মূল্য পরিশোধ করে দেয়ার সময় সে দাঁড়িয়ে যায় এবং নতুন সামগ্রী ক্রয় করে— এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
উত্তর:
এটা দোষনীয় নয়, যখন সেখানে পূর্ব থেকেই কোন প্রকার সমঝোতা ও বুঝাপড়া না থাকে; তবে ইমাম আহমদ র. এর মতে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে সে চলে যাবে এবং অন্য জায়গায় অনুসন্ধান করবে, তারপর সেখান থেকে ক্রয় করবে; আর এটা যদি সহজ না হয়, তাহলে সে যার নিকট প্রথমে বিক্রয় করেছে, তার নিকট ফিরে আসবে এবং তার নিকট থেকে ক্রয় করবে, এইভাবে তার অপকৌশল গ্রহণ করার সন্দেহ থেকে বেঁচে থাকা হবে।
* * *

দশম প্রশ্ন: কোনো ব্যক্তি দোকানদারের নিকট স্বর্ণ বিক্রি করল (কিন্তু অর্থ গ্রহণ করেনি), অতঃপর সে দোকানদারের নিকট থেকে অন্য স্বর্ণ ক্রয় করল প্রায় সেই পরিমাণ, যেই পরিমাণ সে তার কাছে বিক্রি করেছে। অতঃপর ক্রেতা ক্রয়কৃত স্বর্ণের মূল্য ঐ অর্থ থেকে পরিশোধ করল যা সে দোকানদারের নিকট বিক্রি করেছিল কিন্তু উক্ত মূল্য গ্রহণ না করে দোকানদারের কাছে রেখে দিয়েছিল। — এমতাবস্থায় তার বিধান কী হবে?
উত্তর:
এই ধরনের ক্রয়-বিক্রয় জায়েয নয়; কেননা, যখন কেউ কোনো জিনিস এমন কোনো মূল্যে বিক্রি করে যে মূল্য ক্রেতা থেকে বিক্রেতা নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসে নি, আর সে ঐ মূল্যের বিনিময়ে বিক্রেতার নিকট থেকে এমন কিছু ক্রয় করতে চাচ্ছে যা বাকিতে বিক্রয় করা বৈধ নয়, তখন ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদগণের সুস্পষ্ট বক্তব্য হল— এমন করাটা হারাম; কারণ হতে পারে সে এভাবে মূল্য কবজা করার পূর্বেই অন্য কিছু ক্রয় করে সেটাকে অপকৌশল করে এমন জিনিস বিক্রি করতে চায় যা বাকীতে বিক্রয় করা জায়েয নয়। আর যখন তা একই শ্রেণীভুক্ত হবে, তখন তো অপকৌশলটি হবে (দু’ কারণে নিষিদ্ধ, তা হচ্ছে) ‘অতিরিক্ত গ্রহণ জনিত সুদ’ ( ربا الفضل )[12] এবং ‘বাকি তথা বিলম্ব জনিত সুদ’ ( ربا النسيئة )[13] ভিত্তিক।
* * *

একাদশ প্রশ্ন: যে ব্যক্তি স্বর্ণ ক্রয় করল কিন্তু তার কিছু মূল্য বাকী রাখল এবং বলল: যখন সম্ভব হবে, তখন আমি তোমার মূল্য পরিশোধ করে দিব— এমতাবস্থায় তার বিধান কী হবে?
উত্তর:
এই কাজ বৈধ নয়; আর যখন এ ধরনের কাজ করবে, তখন যেটুকুর বিনিময় গ্রহণ করা হয়েছে ততটুকুর ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হবে; আর যেটুকুর বিনিময় গ্রহণ করা হয়নি ততটুকুতে ক্রয়-বিক্রয় বাতিল বলে গণ্য হবে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« ... بِيعُوا كَيْفَ شِئْتُمْ إِذَا كَانَ يَدًا بِيَدٍ » . ( رواه مسلم ) .
“ ... তোমরা যেভাবে খুশি বিক্রয় কর, যদি তা হাতে হাতে তথা নগদ নগদ হয়।”[14]
* * *

দ্বাদশ প্রশ্ন: সেই ক্ষেত্রে বিধান কী হবে— যে ব্যক্তি স্বর্ণ ক্রয় করল এবং তার উপরই ক্রয়-বিক্রয় শেষ করল, অতঃপর মূল্য পরিশোধ করল এবং মোট মূল্যের কিছু অংশ বাকি থাকল; ফলে সে কি বাকী মূল্য নিয়ে আসার জন্য যে কোনো জায়গায় (যেমন— গাড়ি কিংবা ব্যাংক থেকে নিয়ে আসার জন্য) যাওয়া জায়েয হবে? আর এ ক্ষেত্রে সে কি বাকি মূল্য নিয়ে আসার পরেই স্বর্ণ গ্রহণ করবে? এ ধরনের কাজ ঠিক হবে কিনা, নাকি বাকি মূল্য নিয়ে আসার পরে পুনরায় চুক্তি নবায়ন করা আবশ্যক হবে?
উত্তর:
সবচেয়ে উত্তম হল বাকি মূল্য নিয়ে আসার পরে চুক্তি নবায়ন করা এবং এতে কোন ক্ষতি নেই, যা চুক্তি সম্পাদনের জন্য নির্ধারিত শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়; তবে দামের হেরফের হলে তারও খেয়াল রাখতে হবে। এমতাবস্থায় যদি পূর্বের মূল্যেই চুক্তি সম্পাদন করে তাতে কোনো দোষ নেই। আর যদি বাকি মূল্য নিয়ে আসা পর্যন্ত চুক্তির বিষয়টি বর্জন করে, তাহলে সেটি আরও উত্তম; কেননা, মূল্য হাযির করার পূর্বে চুক্তি সম্পাদনের কোনো যুক্তি নেই; (আর আল্লাহই হলেন সঠিক উত্তর দানের তাওফীক দানকারী)।
* * *

ত্রয়োদশ প্রশ্ন: কোন কোন স্বর্ণের দোকানদার স্বর্ণের ব্যবসায়ীর নিকট যায় এবং তার নিকট থেকে কিলোগ্রাম বা অনুরূপ ওজনে নতুন স্বর্ণ গ্রহণ করে, আর এ স্বর্ণের সাথে মূল্যবান পাথরের মিশ্রণ থাকে, চাই সেই পাথর হউক আলমাস নামক দামী পাথর, অথবা যারাকুন বা অন্য কোন পাথর; আর ক্রেতা তাকে (দোকানদারকে) এ কিলোগ্রামের বিনিময়ে সমপরিমাণ ওজনে খাঁটি সোনা প্রদান করে যাতে কোনো প্রকার পাথর নেই; অতঃপর বিক্রেতা গহনা তৈরির পারিশ্রমিকের নামে (ক্রেতার নিকট থেকে) আরও অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করে।
এভাবে বিক্রেতার নিকট দু’টি বাড়তি বস্তু হয়ে গেল; একটি হল পাথরের ওজনের বিপরীতে অতিরিক্ত স্বর্ণ; আর দ্বিতীয়টি হল গহনা তৈরির পারিশ্রমিক বাবত অতিরিক্ত অর্থ; কারণ, সে হল স্বর্ণ ব্যবসায়ী, স্বর্ণকার নয়।
অতএব, এ ধরনের কাজের বিধান কী হবে (আল্লাহ আপনাকে তাওফীক দিন)?
উত্তর:
এ ধরনের কাজ হারাম; কেননা, তা সুদি কারবারের অন্তর্ভুক্ত; আর প্রশ্নকর্তার বক্তব্যের আলোকে তাতে দুই কারণে সুদ হয়। প্রথম কারণ: বাড়তি স্বর্ণ, যেহেতু এখানে মূল্যবান পাথর বা অনুরূপ কিছুর পরিবর্তে স্বর্ণের বিনিময় হয়েছে; আর তা ঐ হার বা নেকলেসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যা ফুদালা ইবন ‘উবাইদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে আলোচনা করা হয়েছে, যেমন তিনি বলেন:
« اشْتَرَيْتُ يَوْمَ خَيْبَرَ قِلاَدَةً بِاثْنَىْ عَشَرَ دِينَارًا فِيهَا ذَهَبٌ وَخَرَزٌ , فَفَصَّلْتُهَا فَوَجَدْتُ فِيهَا أَكْثَرَ مِنِ اثْنَىْ عَشَرَ دِينَارًا فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم , فَقَالَ : « لاَ تُبَاعُ حَتَّى تُفَصَّلَ » . ( رواه مسلم ) .
“খাইবার বিজয়ের দিন আমি বারো দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) দিয়ে একটি হার ক্রয় করি, যাতে স্বর্ণ ও মুক্তা ছিল; অতঃপর আমি স্বর্ণ ও মুক্তা আলাদা করে দেখলাম যে, তাতে বারো দীনারের বেশি স্বর্ণ আছে; তখন আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিষয়টি জানালাম; তিনি বললেন: স্বর্ণ ও মুক্তা পৃথক না করে তা বিক্রয় করা যাবে না।”[15]
আর দ্বিতীয় কারণ: আর দ্বিতীয় বাড়তি হল গহনা তৈরি করার পারিশ্রমিকের নামে বাড়তি কিছু গ্রহণ; কেননা, বিশুদ্ধ মতে- (বানানো গহনা ক্রয়ের সময়) পারিশ্রমিকের নামে বাড়তি কিছু গ্রহণ করা বৈধ নয়; কারণ, তৈরির বিষয়টি যদিও ব্যক্তি বিশেষের কাজ, কিন্তু তা সুদের প্রাসঙ্গিক বিষয়ে একটি অতিরিক্ত গুণ, যা আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির বিশেষ বাড়তি গুণের সাথে তুলনীয়; আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নমানের দুই সা‘ খেজুরের বিনিময়ে উৎকৃষ্ট মানের এক সা‘ খেজুর ক্রয় করতে নিষেধ করেছেন।[16]
আর মুসলিম ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হল সুদের বিষয়ে সতর্ক হওয়া এবং তা থেকে দূরে থাকা; কেননা, সুদ মহাপাপসমূহের অন্যতম একটি।
* * *

চতুর্দশ প্রশ্ন: ঐসব স্বর্ণের দোকানের মালিকদের অধীনে কাজ করার বিধান কী, যারা শরী‘য়ত পরিপন্থী পদ্ধতিতে লেনদেন করে, চাই তা সুদের ভিত্তিতে হউক, অথবা অবৈধ আপকৌশলের মাধ্যমে হউক, অথবা হউক তা প্রতারণার মাধ্যম, অথবা এর বাইরে শরী‘য়ত পরিপন্থী অন্য যে কোন প্রকারের লেনদেন হউক না কেন?
উত্তর:
ঐসব মালিকদের অধীনে কাজ করা হারাম, যারা সুদের ভিত্তিতে অথবা প্রতারণার মাধ্যম অথবা অনুরূপ যে কোনো প্রকার হারাম পন্থায় লেনদেন করে; কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَلَا تَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِۚ ﴾ [المائ‍دة: ٢]
“আর তোমরা পাপকাজ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না।”[17]
তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَقَدۡ نَزَّلَ عَلَيۡكُمۡ فِي ٱلۡكِتَٰبِ أَنۡ إِذَا سَمِعۡتُمۡ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ يُكۡفَرُ بِهَا وَيُسۡتَهۡزَأُ بِهَا فَلَا تَقۡعُدُواْ مَعَهُمۡ حَتَّىٰ يَخُوضُواْ فِي حَدِيثٍ غَيۡرِهِۦٓ إِنَّكُمۡ إِذٗا مِّثۡلُهُمۡۗ ﴾ [النساء: ١٤٠]
“কিতাবে তোমাদের প্রতি তিনি তো নাযিল করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে এবং তা নিয়ে বিদ্রূপ করা হচ্ছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসংগে লিপ্ত না হবে তোমরা তাদের সাথে বসো না, নয়তো তোমরাও তাদের মত হবে।”[18]
আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ , فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ , فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ » . ( رواه مسلم ) .
“তোমাদের কেউ যখন কোন খারাপ কাজ হতে দেখে, তখন সে যেন তা হাত দিয়ে (শক্তি প্রয়োগে) বন্ধ করে দেয়; যদি সে এ ক্ষমতা না রাখে, তবে যেন মুখের দ্বারা (জনমত গঠন করে) তা বন্ধ করে দেয়; আর যদি সে এ ক্ষমতাটুকুও না রাখে, তবে যেন সে অন্তরের দ্বারা (পরিকল্পিত উপায়ে) তা বন্ধ করার চেষ্টা করে বা এর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে।”[19]
আর কর্মচারী তাদের নিকটে থেকে তার হাত, মুখ ও অন্তর- কোনটা দ্বারাই তা বন্ধ করতে পারবে না; ফলে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্য বলে বিবেচিত হবে।
* * *

পঞ্চদশ প্রশ্ন: স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে চেকের মাধ্যমে লেনদেনের বিধান কী হবে, যখন চেকটি ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সঠিক ও যথাপোযুক্ত হবে; যেহেতু কোনো কোনো স্বর্ণের মালিক নিজের জীবনের ব্যাপারে আশংকার কারণে ও তার থেকে তার দিরহাম চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে চেকের মাধ্যমে লেনদেন করে?
উত্তর:
স্বর্ণ অথবা রৌপ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে চেকের মাধ্যমে লেনদেন করা বৈধ নয়; আর এটা এ জন্য যে, চেক গ্রহণের দ্বারা প্রকৃত অর্থে হস্তগত বা দখলকরণ হয় না, বরং তা শুধু একটি নির্ভরযোগ্য বিনিময়পত্র মাত্র; এর যুক্তি হল, যে ব্যক্তি চেক গ্রহণ করল তার নিকট থেকে যদি তা বিনষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সে তার দাবি নিয়ে আবার ঐ ব্যক্তির নিকট ফিরে আসবে, যে তাকে তা দিয়েছে; আর অপরদিকে যদি তা হস্তগত বা দখল বলে গণ্য হত, তাহলে সে তার নিকট দাবি নিয়ে ফিরে আসত না।
এর বিবরণ হল, কোনো ব্যক্তি যদি দিরহামের বিনিময়ে স্বর্ণ ক্রয় করে এবং বিক্রেতাকে দিরহাম প্রদান করে, আর বিক্রেতা তা নিয়ে তার দোকানে চলে গেল, তারপর তার নিকট থেকে তা নষ্ট হয়ে গেল, তাহলে সে ক্রেতার নিকট তার দাবি নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না; পক্ষান্তরে যদি সে ক্রেতার নিকট থেকে চেক গ্রহণ করে, তারপর ব্যাংক থেকে উত্তোলনের জন্য তা নিয়ে যায়, তারপর তার নিকট থেকে তা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সে ক্রেতার নিকট তার স্বর্ণের মূল্যের দাবি নিয়ে ফিরে যেতে পারবে; আর এটাই হল প্রমাণ যে, চেক মানে হস্তগত বা দখল নয়; আর চেক যখন হস্তগত বা দখলকরণ বলে গণ্য হয় না, তখন ক্রয়-বিক্রয়ও শুদ্ধ হবে না; কেননা, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বর্ণ ও রৌপ্য নগদ মূল্যে বিক্রয় করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে চেক যখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সত্যায়িত হয় এবং ব্যাংকের সাথে বিক্রেতার কথাবার্তা অনুষ্ঠিত হয়, আর বিক্রেতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে বলে: আপনার নিকট আমার দিরহামগুলো আমানত হিসেবে রেখে দিন, তখন এ ক্ষেত্রে হয়ত সে সুযোগ (চেকের মাধ্যমে লেন-দেন করার অনুমতি) দেওয়া যেতে পারে। আর আল্লাহই সবচেয়ে বেশি জানে।
* * *

ষোড়শ প্রশ্ন: যে স্বর্ণের মধ্যে কোন প্রতীক থাকে অথবা প্রজাপতি বা সাপের মাথা অথবা এ ধরনের কোন ছবি থাকে, সেই স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান কী?
উত্তর:
প্রাণীর ছবিসহ তৈরি স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলঙ্কার বিক্রয়, ক্রয় ও পরিধান করা হারাম এবং তা গ্রহণ করাও হারাম; আর এটা এ জন্য যে, মুসলিম ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হল ছবি নিশ্চিহ্ন ও অপসারণ করা; যেমনটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হাদিসের মধ্যে আছে, আবূল হাইয়্যাজ আল-আসাদী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« قَالَ لِى عَلِىُّ بْنُ أَبِى طَالِبٍ : أَلاَّ أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِى عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ لاَ تَدَعَ تِمْثَالاً إِلاَّ طَمَسْتَهُ , وَلاَ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْتَهُ » . ( رواه مسلم ) .
“আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আমাকে বলেন, আমি কি তোমাকে এমন এক কাজে প্রেরণ করব না, যে কাজে আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরণ করেছিলেন— তুমি কোনো মূর্তি বা ভাস্কর্য মূলোৎপাটন না করে ছাড়বে না; আর উঁচু কবর মাত্রই ভেঙ্গে মাটির সমান করে দিবে।”[20]
আর আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত অপর এক হাদিসে রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« إِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لاَ تَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ صُورَةٌ » . ( متفق عليه ) .
“যে ঘরে (প্রাণীর) ছবি থাকে, সে ঘরে ফিরিশ্তা প্রবেশ করে না।”[21]
আর এসব দলীল-প্রমাণের উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, মুসলিম ব্যক্তিবর্গের উপর আবশ্যক হল এ ধরনের অলঙ্কার ব্যবহার ও ক্রয়-বিক্রয় পরিহার করে চলা।
* * *

সপ্তদশ প্রশ্ন: স্বর্ণ আটক করা বা বুকিং (booking) দেয়ার বিধান কী?— আর এ বুকিং (booking) মানে হল, মূল্যের কিছু অংশ পরিশোধ করে পুরা মূল্য পরিশোধ করে দেয়া পর্যন্ত ব্যবসায়ীর নিকট তা আমানত হিসেবে রেখে দেওয়া।
উত্তর:
এটা বৈধ নয়; কারণ, যখন সে তা বিক্রয় করবে, তখন ক্রয়-বিক্রয়ের চাহিদা বা দাবি হল বিক্রেতার কাছ থেকে তার মালিকানা ক্রেতার নিকট স্থানান্তরিত হওয়া; সুতরাং এ ধরনের বুকিং (booking) পদ্ধতি হারাম ও অবৈধ, বরং জরুরি হল বিক্রেতা কর্তৃক পুরা মূল্য গ্রহণ করা; অতঃপর ক্রেতা ইচ্ছা করলে তা বিক্রেতার নিকট রেখে দিবে, আর ইচ্ছা করলে তা গ্রহণ করবে; তবে হ্যাঁ, যদি সে তার পক্ষ থেকে দাম বলে এবং বিক্রেতা সে দামে বিক্রি না করে, তারপর সে (ক্রেতা) চলে যায় এবং বাকি মূল্য নিয়ে আসে, অতঃপর চুক্তি সম্পন্ন হয় এবং এর পরে তা গ্রহণ করে, তাহলে এটা বৈধ হবে; কারণ, (এখানে) মূল্য উপস্থিত করার পরেই চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
* * *

অষ্টাদশ প্রশ্ন: মূল্য গ্রহণ করার পূর্বে স্বর্ণ বের কেরে দেয়ার বিধান কী হবে— যখন সে নিকটতম কেউ হওয়ার কারণে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কায় এরূপ করে, অথচ তার পূর্ণ আস্থা আছে যে, সে অচিরেই তার মূল্য পরিশোধ করে দিবে, যদিও কিছু সময় বিলম্ব হবে?
উত্তর:
তোমার সাধারণ নিয়ম জেনে রাখা আবশ্যক যে, পুরাপুরি মূল্য গ্রহণ করা ব্যতীত মুদ্রার বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রয় করা কখনও বৈধ হবে না, এ ক্ষেত্রে নিকটতম ও দূরতম সম্পর্কের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই; কেননা, আল্লাহর দীন এ ব্যাপারে কারও পক্ষপাতিত্ব করে না। আর যখন আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করার কারণে কোনো নিকটতম ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হয়, তাহলে সে ক্ষুব্ধ হউক; কেননা, সে জালিম, অপরাধী পাপী, যে নাকি তোমার কাছে আবদার করে যে, তুমি আল্লাহর অবাধ্যতায় জড়িয়ে যাও। আর বাস্তবে তুমি মুক্ত হয়ে গিয়েছ, যখন তুমি তাকে তোমার সাথে হারাম বা অবৈধ লেনদেন করতে নিষেধ করে দিয়েছ; সুতরাং সে যখন এ কারণে তোমার প্রতি ক্ষুব্ধ হবে, তখন সে হবে পাপী, তোমার উপর তার পাপের কিছুই বর্তাবে না।
* * *

ঊনবিংশ প্রশ্ন: এর বিধান কী হবে— ক্রেতা কর্তৃক পরামর্শ করার উদ্দেশ্যে নেয়া স্বর্ণের বিপরীতে কোনো ব্যবসায়ী (ক্রেতা থেকে) স্বর্ণ গ্রহণ করল; আর ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ক্রেতা যা গ্রহণ করেছে ক্রেতা কর্তৃক তা ফেরত দেয়া পর্যন্ত ব্যবসায় এ স্বর্ণটি বন্ধক হিসেবে গ্রহণ করেছে, অথচ এটা নিশ্চিত জানা কথা যে, ক্রেতা কর্তৃক গৃহীত স্বর্ণ ও ব্যবসায়ী কর্তৃক বন্ধক হিসেবে গৃহীত স্বর্ণের মাঝে ওজনের ক্ষেত্রে তারতম্য রয়েছে?
উত্তর:
এতে কোনো সমস্যা নেই; কেননা সে তা তার নিকট বিক্রি করেনি; সে তো শুধু বলেছে: এ স্বর্ণটা আপনার কাছে বন্ধক হিসেবে রাখুন, আর আমি (আপনার দেওয়া স্বর্ণ নিয়ে) যাব এবং তার বিষয়ে পরামর্শ করব, অতঃপর আমি আপনার নিকট ফিরে আসব এবং আমরা নতুন করে ক্রয়-বিক্রয় করব; অতঃপর যখন আমরা উভয়ে বেচাকেনার কাজ শেষ করব, তখন ক্রেতা বিক্রেতাকে পুরাপুরি মূল্য পরিশোধ করে দিবে এবং ক্রেতা তা গ্রহণ করে নিবে, যা সে বিক্রেতার কাছে বন্ধক হিসেবে দিয়েছিল।
* * *

বিংশ প্রশ্ন: কোনো ব্যক্তি এক টুকরা স্বর্ণ দুইশত দিনার মূল্যে ক্রয় করল এবং স্বর্ণের দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি হওয়া পর্যন্ত সময় ধরে তা সংরক্ষণ করল, অতঃপর তা তিন হাজার দিনারের বিনিময়ে বিক্রি করল— সুতরাং এ ধরনের বৃদ্ধির বিধান কী হবে?
উত্তর:
এই ধরনের বৃদ্ধিতে কোন প্রকার সমস্যা বা অসুবিধা নেই; আর মুসলিমগণ তো তাদের ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সর্বদা এরূপ করেই থাকে, তারা পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে এবং মূল্য বৃদ্ধির জন্য অপেক্ষা করে; আবার কখনও কখনও তারা নিজেদের ব্যবহারের জন্য পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে, অতঃপর যখন তার দাম অধিক হারে বৃদ্ধি পায় এবং তা বিক্রয়ের সুযোগ পেয়ে যায়, তখন তারা তা বিক্রি করে দেয়, যদিও ইতিপূর্বে তা বিক্রি করার কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না।
আর তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, মূল্য বৃদ্ধি যখন বাজারের অনুগামী, তখন তাতে কোনো ধরনের অসুবিধা নেই, যদিও বৃদ্ধির পরিমাণটা অনেক গুণ বেশি হয়ে যায়। কিন্তু যদি বৃদ্ধির বিষয়টি একটি স্বর্ণের বিনিময়ে অপর আরেকটি স্বর্ণের ক্ষেত্রে হয় এবং অপর স্বর্ণের বেলায় অতিরিক্ত গ্রহণ করা হত, তাহলে তা হারাম হবে। কারণ, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণের ক্রয়-বিক্রয় ওজনে সমান সমান এবং নগদ নগদ না হলে বৈধ হবে না, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত। সুতরাং তুমি যখন স্বর্ণকে স্বর্ণের বিনিময়ে বিক্রি করবে, যদিও তা মানের দিক থেকে ভিন্ন রকম (অর্থাৎ একটি অপরটির চেয়ে উৎকৃষ্ট), তখন সে ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হবে না, যতক্ষণ তা ওজনে সমান সমান এবং হাতে হাতে বা নগদ নগদ না হবে। অতএব, তুমি যদি ১৮ কেরেটের দুই মিসকাল স্বর্ণ ২৪ কেরেটের দেড় মিসকাল স্বর্ণের বিনিময়ে গ্রহণ কর, তাহলে তা হারাম ও অবৈধ হবে; কেননা, এ ক্ষেত্রে সমপরিমাণ হওয়া আবশ্যক; আর তুমি যদি দুই মিসকাল স্বর্ণের বিনিময়ে দুই মিসকাল স্বর্ণ গ্রহণ কর, কিন্তু দু’টির যে কোনো একটি গ্রহণে বিলম্ব বা বাকি কর, তাহলে এ ক্রয়-বিক্রয়ও বৈধ হবে না; কেননা, চুক্তি সম্পাদনের মাজলিসেই লেনদেন সম্পন্ন হওয়া জরুরি। আর একই বিধান প্রযোজ্য হবে প্রচলিত কাগজি মুদ্রার বিনিময়ে স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে (অর্থাৎ বিনিময় নগদ নগদ হতে হবে)। সুতরাং মানুষ যখন কোনো ব্যবসায়ী অথবা স্বর্ণকারের নিকট থেকে কাগজি মুদ্রার বিনিময়ে স্বর্ণ ক্রয় করে, তখন তার জন্য বিক্রেতাকে পুরা মূল্য পরিশোধ না করে তার নিকট থেকে বিচ্ছন্ন হওয়া বৈধ নয়; কেননা, এসব কাগজি মুদ্রা রৌপ্যের মুদ্রার মতই; আর রৌপ্যের বিনিময়ে স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে চুক্তি সম্পাদনের মাজলিসে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বে পারস্পরিক লেনদেন সম্পন্ন করা আবশ্যক; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« إِذَا اخْتَلَفَتْ هَذِهِ الأَصْنَافُ فَبِيعُوا كَيْفَ شِئْتُمْ إِذَا كَانَ يَدًا بِيَدٍ » . ( رواه مسلم ) .
“এই জাতীয় দ্রব্যগুলো যখন এক জাতীয় না হয়ে ভিন্ন রকমের হবে, তখন তোমরা যেভাবে খুশি বিক্রয় করতে পারবে, যদি তা হাতে হাতে তথা নগদ নগদ হয়।”[22]
* * *

একবিংশ প্রশ্ন: পুরুষের পরিধানের জন্য তৈরি করা স্বর্ণের বিশেষ আংটি বিক্রয়ের বিধান কী হবে, যখন ব্যবসায়ী নিশ্চিত যে, ক্রেতা অচিরেই তা পরিধান করবে?
উত্তর:
পুরুষের জন্য তৈরি করা স্বর্ণের আংটি বিক্রয় করা হারাম, যখন বিক্রেতা জানতে পারবে যে, ক্রেতা অচিরেই তা পরিধান করবে অথবা তার প্রবল ধারণা মতে সে তা পরিধান করার সম্ভাবনা থাকবে; কারণ, এ উম্মতের পুরুষ ব্যক্তিদের উপর স্বর্ণ ব্যবহার করা হারাম; সুতরাং সে যখন তা এমন ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করবে, যার ব্যাপারে সে জানে অথবা তার প্রবল ধারণা হয় যে, সে তা পরিধান করবে, তখন সে অন্যায় কাজে সহযোগিতা করল; অথচ আল্লাহ তা‘আলা অন্যায় ও সীমালংঘনের কাজে সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছেন; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ۘ وَتَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡبِرِّ وَٱلتَّقۡوَىٰۖ وَلَا تَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِۚ ﴾ [المائ‍دة: ٢]
“আর নেককাজ ও তাক্ওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না।”[23]
আর পুরুষ ব্যক্তিদের পরিধানের জন্য স্বর্ণকার কর্তৃক স্বর্ণের আংটি তৈরি করা বৈধ নয়।
* * *

দ্বাবিংশ প্রশ্ন: পুরুষদের জন্য স্বর্ণ পরিধান করা নিষিদ্ধকরণের কারণটি কী? কেননা, আমরা জানি যে, দীন ইসলাম মুসলিম ব্যক্তির উপর শুধু ঐসব বস্তুই হারাম করে, যাতে তার জন্য ক্ষতিকারক দিক রয়েছে— সুতরাং স্বর্ণের তৈরি অলংকার পরিধান করার মধ্যে পুরুষদের জন্য কী ক্ষতি রয়েছে?
উত্তর:
হে প্রশ্নকর্তা! আপনি জেনে রাখুন এবং যারা এ প্রোগ্রাম[24] বা অনুষ্ঠান শুনছেন তারা সকলেই জেনে রাখবেন যে, প্রত্যেক মুমিনের জন্য শরী‘য়তের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান কারণ হল আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রসূলের বাণী বা বক্তব্য; কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٖ وَلَا مُؤۡمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمۡرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُ مِنۡ أَمۡرِهِمۡۗ ﴾ [الاحزاب: ٣٦]
“আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ের ফয়সালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য সে বিষয়ে তাদের কোন (ভিন্ন সিদ্ধান্তের) ইখতিয়ার সংগত নয়।”[25]
সুতরাং যে কেউ আমাদেরকে কোনো বস্তু ওয়াজিবকরণ অথবা নিষিদ্ধকরণের ব্যাপারে আল-কুরআন ও আস-সুন্নাহ’র হিকমত ও তাৎপর্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, তার উত্তরে আমরা বলব: এ ব্যাপারে অন্যতম প্রধান কারণ হল আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রসূলের বাণী বা বক্তব্য; আর এ কারণটিই প্রত্যেক মুমিনের জন্য যথেষ্ট; আর এ জন্যই যখন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে জিজ্ঞেস করা হল, ঋতুবর্তী নারীর কি অবস্থা— সে সাওমের কাযা আদায় করবে, অথচ সালাতের কাযা আদায় করবে না? তখন জবাবে তিনি বলেন:
« كَانَ يُصِيبُنَا ذَلِكَ فَنُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّوْمِ وَلاَ نُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّلاَةِ » . ( متفق عليه ) .
“আমরা এ পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম; তখন আমাদেরকে সাওমের কাযা আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; সালাতের কাযা আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়নি।”[26]
কেননা, আল্লাহর কিতাব অথবা তাঁর রাসূলের সুন্নাহ’র অন্তর্ভুক্ত ‘নস’ তথা বক্তব্য প্রত্যেক মুমিনের জন্য শরী‘য়ত সাব্যস্ত হওয়ার আবশ্যকীয় ‘ইল্লাত বা কারণ; কিন্তু জনগণ কর্তৃক আল্লাহর বিধানসমূহের হিকমত ও তাৎপর্য অনুসন্ধান করাটা দোষের নয়; কারণ, এটা তার আস্থা ও বিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়, তাছাড়া এটা ইসলামী শরী‘য়তের মর্যাদা বর্ণনা করে, যেহেতু বিধিবিধানসমূহ তার হেতু বা যৌক্তিকতার সাথে সংযুক্ত; আর তাছাড়া এর দ্বারা কিয়াসের ক্ষেত্র তৈরি হয়, যখন শরী‘য়তের বক্তব্য দ্বারা নির্ধারিত এ বিধানটির ‘ইল্লত বা কারণ অপর কোনো বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান থাকে, যার ব্যাপারে শরী‘য়তের কোনো ‘নস’ বা স্পষ্ট বক্তব্য নেই। সুতরাং শর‘য়ী হিকমত ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানার এ তিনটি উপকারিতা রয়েছে।

এগুলোর পর ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে আমরা বলতে চাই যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে স্বর্ণ পরিধান করা নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়েছে পুরুষদের জন্য, নারীদের জন্য নয়; আর এর কারণ হল, স্বর্ণ হল সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের বস্তু, যার দ্বারা মানুষ সুসজ্জিত হয় এবং সুন্দর রূপ ধারণ করে; সুতরাং এটা হল সৌন্দর্য ও অলঙ্কার; আর পুরুষের উদ্দেশ্য এসব বিষয় নয়, অর্থাৎ সেই পুরুষ (পরিপূর্ণ) মানুষ নয়, যে অন্যের দ্বারা পরিপূর্ণতা অর্জন করে, বরং পুরুষ সেই, যে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ; কেননা, তার মধ্যে পুরুষত্ব আছে; তাছাড়া অপর ব্যক্তিকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য সুন্দর সাজ গ্রহণ করা পুরুষের কোনো প্রয়োজন নেই; তবে নারীর বিষয়টি তার বিপরীত; কেননা, নারী অসম্পূর্ণ, তার সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা বিধানের প্রয়োজন রয়েছে; তাছাড়া সর্বোচ্চ মানের অলঙ্কার দ্বারা তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে, এমনকি তার ও তার স্বামীর মাঝে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতার জন্য এ ধরনের সুসজ্জিত হওয়ার বিষয়টি দাবি করে; সুতরাং এ কারণেই নারীর জন্য স্বর্ণের অলঙ্কার পরিধান করার বিষয়টি বৈধ করে দেওয়া হয়েছে, পুরুষের জন্য নয়; আল্লাহ তা‘আলা নারীর গুণ বা বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন:
﴿ أَوَ مَن يُنَشَّؤُاْ فِي ٱلۡحِلۡيَةِ وَهُوَ فِي ٱلۡخِصَامِ غَيۡرُ مُبِينٖ ١٨ ﴾ [الزخرف: ١٨]
“আর যে অলঙ্কারে লালিত-পালিত হয় এবং সে বিতর্ককালে স্পষ্ট বক্তব্যে অসমর্থ, সে কি? (আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত হবে?)।”[27]
আর এরই মাধ্যমে পুরুষদের উপর স্বর্ণ পরিধান করা নিষিদ্ধকরণের মধ্যকার শর‘য়ী হিকমত ও তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে যায়। তাই এ প্রসঙ্গে আমি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি ঐসব পুরুষদের নসিহত করার জন্য, যারা স্বর্ণের অলঙ্কার পরিধান করে বিপথগামী হয়েছে; কেননা, তারা এর দ্বারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্য হয়ে গেছে এবং তারা নিজেদেরকে নারীদের সাথে সম্পৃক্ত করেছে; আর তারা অলঙ্কার হিসেবে পরিধানের জন্য আগুনের জ্বলন্ত অঙ্গার তাদের হাতে তুলে নিয়েছে, যা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত। সুতরাং তাদের জন্য জরুরি হল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র নিকট তাওবা করা; আর যদি তারা শরী‘য়তের সীমারেখার মধ্যে থেকে রৌপ্যের অলঙ্কার পরিধান করতে চায়, তাহলে এতে কোনো অসুবিধা নেই; অনুরূপভাবে স্বর্ণ ব্যতীত অন্যান্য খনিজ পদার্থ থেকে তৈরি আংটি পরিধান করতেও তাদের জন্য দোষের কিছু হবে না, যদি তা অপচয় বা ফিতনার পর্যায়ে না পৌঁছায়।


ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকুরী করার বিধান

                                                                
ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকুরী করার বিধান


                                             ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকুরী করার বিধান

আমাদের দেশে ইনস্যুরেন্স বা বীমা কোম্পানিগুলো অধিকাংশই বাণিজ্যিক, যা সবই প্রতারণা ও সুদ নির্ভর। তাই এ সকল কোম্পানিতে চাকুরী করা বা তাতে অর্থ লগ্নি করা হারাম।
আন্তর্জাতিক ফিকহ একাডেমি (ওআইসির একটি শাখা সংস্থা) এবং সউদী আরবের উচ্চ উলামা পরিষদ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, সব ধরণের বাণিজ্যিক বীমা হারাম। চাই তা জীবন বীমা হোক বা সম্পদের বীমা হোক।

তার কারণ সমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হল:

প্রথমত: বাণিজ্যিক জীবন বীমা হচ্ছে এমন একটি চুক্তি যাতে অর্থের বিনিময় হয়ে থাকে। কিন্তু তাতে আছে কঠিন ধোঁকার সম্ভাবনা। কেননা বীমাকারীর পক্ষে চুক্তির সময় একথা জানা সম্ভব নয় যে, কি পরিমাণ অর্থ সে প্রদান করবে এবং কি পরিমাণ গ্রহণ করবে। এমনও হতে পারে যে, সে হয়তো এক বা দু কিস্তি অর্থ প্রদান করল এবং তারপরেই কোন দুর্ঘটনা ঘটল। তখন বীমা কর্তৃপক্ষ শর্ত অনুযায়ী বিরাট পরিমাণ অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে। হতে পারে কোন দুর্ঘটনাই ঘটল না। তখন বীমাকারী সকল কিস্তি পরিশোধ করতেই থাকবে। অথচ বেঁচে থাকতে সে শেষে কিছুই পাবে না; তার মৃত্যুর পর তার ওয়ারিছগণ পাবে।
সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘বাই গারার’বা প্রতারণা ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা থেকে নিষেধ করেছেন।(মুসলিম)

দ্বিতীয়ত: বাণিজ্যিক বীমা মূলত: এক ধরণের জুয়া। কেননা এখানে অর্থ আদান-প্রদানে ঝুঁকি ও প্রতারণার সুযোগ আছে। বিনা অপরাধে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ আছে আবার বিনা প্ররিশ্রমে ও বিনিময় ছাড়াই অধিক লাভবান হওয়ারও সুযোগ আছে। কেননা বীমাকারী কয়েক কিস্তি দেয়ার পর কোন দুর্ঘটনায় পতিত হল, তখন কর্তৃপক্ষ বীমার যাবতীয় অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে, ফলে কর্তৃপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর যদি কোন দুর্ঘটনা না ঘটে তবে কর্তৃপক্ষ বীমার কিস্তির মাধ্যমে লাভবান হতেই থাকবে। অথচ তাদের এই লাভ বিনিময় ছাড়াই হচ্ছে। অতএব এখানে যখন অজ্ঞতা সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তখন তা নিষিদ্ধ জুয়ার পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছে। আর আল্লাহ কুরআনে জুয়াকে হারাম করেছেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য ব্যতীত অন্য কিছু নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও।” (মায়েদাঃ ৯০)

তৃতীয়ত: বাণিজ্যিক বীমায় তাৎক্ষণিক ও বিলম্বে সুদের ব্যবস্থা আছে। কেননা বীমা কোম্পানি গ্রাহককে বা তার উত্তরাধিকারকে বা অনুমোদিত ব্যক্তিকে জমা কৃত অর্থের চেয়ে বেশী প্রদান করবে, ফলে তা তাৎক্ষণিক সুদের পর্যায়ভুক্ত গণ্য হবে। আর এই প্রদানটি নির্দিষ্ট একটি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর দেয়ার কারণে তা বিলম্ব সুদেরও অন্তর্ভুক্ত হবে। আর উভয় প্রকার সুদ হারাম।

চতুর্থত: বাণিজ্যিক বীমা নিষিদ্ধ বাজির অন্তর্ভুক্ত। কেননা উভয় ক্ষেত্রে (বীমা ও বাজিতে) অজ্ঞতা, ধোঁকা ও জুয়ার সুযোগ আছে। আর ইসলামের উপকার ও সহযোগিতার উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোন ক্ষেত্রে বাজি ধরাকে শরীয়ত নিষেধ করেছে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাজি ধরার বৈধতাকে শুধু তিনটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন,
“উট ও ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা এবং তীর নিক্ষেপ ব্যতীত অন্য কোন ক্ষেত্রে বাজী ধরা চলবে না।” (আবু দাউদ)

পঞ্চমত: বাণিজ্যিক বীমার মাধ্যমে অন্যের সম্পদ বিনিময় ব্যতীত অর্জন করার সুযোগ আছে। আর বাণিজ্যিক চুক্তিতে বিনিময় ছাড়া অর্থ উপার্জন হারাম। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ।” (নিসাঃ ২৯)

ষষ্ঠত: বাণিজ্যিক বীমায় এমন কিছু নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করা হয়, শরীয়তে যা বাধ্য করা হয়নি। এই চুক্তিতে বীমা কর্তৃপক্ষ থেকে কোন দুর্ঘটনা আসেনি বা দুর্ঘটনার কোন কারণও হয়নি, তবু শুধু বামী কারীর সাথে চুক্তির কারণে ‘দুর্ঘটনা হতে পারে’এমন অনুমানের ভিত্তিতে বিমাকারীর কিছু অর্থের বিনিময়ে তাকে অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে। এই জন্য এটা হারাম লেনদেন।
ইসলামী শরীয়ত মানুষকে হালাল ভাবে অর্থ উপার্জন ও খরচ করতে যেমন আদেশ করেছে, তেমনি সকল প্রকার হারাম উপার্জনকে বর্জন করতে কঠোরভাবে তাগিদ দিয়েছে। অন্যতম হারাম উপার্জন হচ্ছে সুদ, যা বিশেষভাবে এই বাণিজ্যিক বীমায় প্রদান করা হয়। এই সুদকে শরীয়ত যেমন হারাম করেছে, তেমনি সুদের সাথে জড়িত সকলকেই অপরাধী সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ বলেন,
وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا
“আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।” (বাকারাঃ ২৭৫)
عَنْ جَابِرٍ قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آكِلَ الرِّبَا وَمُؤْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ وَقَالَ هُمْ سَوَاءٌ
জাবের রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লা’নত করেছেন তার উপর যে সুদ খায়, যে সুদ দেয়, যে সুদ লেখে এবং সুদের ব্যাপারে যারা সাক্ষী থাকে। তারা সকলেই সমান অপরাধী।” (মুসলিম)


অনুবাদক: আবদুল্লাহ আল কাফী (লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব


ইসলামের দৃষ্টিতে ঋণ লেন-দেন

                                                                          
  ইসলামের দৃষ্টিতে ঋণ লেন-দেন


                                                          ইসলামের দৃষ্টিতে ঋণ লেন-দেন

আলহামদু লিল্লাহ, ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিল্লাহ, আম্মাবাদ,
সুপ্রিয় পাঠক! ঋণ-কর্জ মানুষের তথা সমাজের একটি প্রয়োজনীয় লেনদেন। সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেক ব্যক্তি জিবন-যাপন করার ক্ষেত্রে কোনো না কোনো সময় ঋণ নেওয়ার কিংবা অন্যকে দেওয়ার সম্মুখীন হতে হয়। তবে এই মানবীয় সুন্দর নিয়ম এবং অপরকে সহযোগিতা করার এই ইসলামী সুপ্রথাও অনেক সময় কুমতলবীর চক্রান্তে ও মায়াজালে ফেঁসে বিদ্বেষ, ঝগড়া-ঝাঁটি এমনকি বড় রকমের শত্রুতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর অনেকে তো এই ঋণ প্রথাকেই পুঁজি জমা করার উপায় হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বে পুঁজিপতি হয়েছে ও হচ্ছে। আর দরিদ্র সম্প্রদায় তাদের মুখাপেক্ষী হওয়ার কারণে ঋণের জাঁতায় পিষ্ট হচ্ছে। আমরা এই প্রবন্ধে ইসলামে ঋণের বিধি-বিধান সম্পর্কে কিছুটা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। যেন ঋণের সঠিক বিধান জানতে পারি এবং বেঠিক বিধান হতে নিরাপদে থাকতে পারি। ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।


ঋণের অর্থঃ
ঋণের আরবী শব্দ ‘কায্র্’, যা প্রচলিত বাংলা ভাষায় কর্জ নামে পরিচিত। এর বাংলা সমার্থবোধক শব্দ হচ্ছে, দেনা, ধার, হাওলাদ ইত্যাদি।
শরীয়তের পরিভাষায় ঋণঃ
মাল-পণ্য অপরকে প্রদান করা, যেন তার মাধ্যমে সে উপকৃত হয়, অতঃপর দাতাকে সেই মাল কিংবা তার অনুরূপ ফেরত দেওয়া। [ফিক্হ বিশ্বকোষ, খন্ড ৩৩, পৃঃ১১১]
ঋণের বৈধতাঃ
ঋণ প্রথা বৈধ, যা সুন্নত এবং ইজমা (ঐক্যমত) দ্বারা প্রমাণিত। [মুগনী, ইবনু কুদামাহ,৬/৪২৯]
নবী (সাঃ) একদা এক উষ্ট্রী ধার নেন এবং ফেরত দেওয়ার সময় সেই সমগুণের উষ্ট্রী না পাওয়ায় তার থেকে উত্তম গুণের পুরুষ উট ফেরত দেন এবং বলেনঃ “তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি সে, যে উত্তম ঋণ পরিশোধকারী।’’ [বুখারী ,অধ্যায়,ইস্তিকরায, নং২৩৯০]
ঋণ যোগ্য জিনিসাদিঃ
অর্থাৎ কি কি জিনিস ঋণের অন্তর্ভুক্ত, যা ঋণ হিসাবে আদান-প্রদান করা যেতে পারে? এ বিষয়ে ফুকাহাদের মতভেদ বিদ্যমান। তবে নির্ভরযোগ্য মত হচ্ছে, প্রত্যেক এমন বস্তু যা বিক্রয় করা বৈধ, তা ঋণ দেওয়াও বৈধ। [যাদুল্ মুস্তাক্বনা’, হিজাভী/২১২]


ঋণ প্রদানের ফযীলত

ঋণ প্রদান একটি নেকির কাজ, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে। এর মাধ্যমে লোকের সাহায্য করা হয়, তাদের প্রতি দয়া করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা হ্রাস করা হয় কিংবা সমাধান করা হয়।
নবী (সাঃ) বলেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দুনিয়াবী বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তাআলা তার আখেরাতের বিপদ দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবীর কষ্ট সহজ করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতে সহজ করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্য করেন যতক্ষণে বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করে।” [মুসলিম,অধ্যায়ঃ যিকর, দুআ,তাওবাহ ও ইস্তিগফার]
নবী (সাঃ) আরো বলেনঃ ‘‘যে কেউ কোনো মুসলিমকে দুই বার ঋণ দেয়, তা সেই অনুযায়ী এক বার সাদাকা করার মত।’’ [ইবনু মাজাহ, সূত্র হাসান,ইরওয়াউল গালীল নং১৩৮৯]


ঋণ লেন-দেনে মেয়াদ নির্ধারণ

বিষয়টির ব্যাখ্যা হচ্ছে, ঋণ দাতা এবং ঋণ গ্রহীতা লেন-দেনের সময় একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ নির্ধারণ করতে পারে কি পারে না? সঠিক মত হচ্ছে, মেয়াদ নির্ধারিত করতে পারে এবং প্রয়োজনে মেয়াদ বৃদ্ধিও করতে পারে। কারণ
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ "হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধারে কারবার করবে, তখন তা লিখে রাখবে।" [সূরা বাকারাহ - ২৮২]
অতঃপর মেয়াদ নির্ধারিত থাকলে ঋণদাতা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ঋণ গ্রহীতার নিকট থেকে ঋণ ফেরত নেওয়ার দাবী করতে পারে না। বরং সে নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বাধ্য। কারণ নবী (সাঃ) বলেনঃ ‘‘মুসলিমগণ শর্ত পূরণে বদ্ধপরিকর।” [আহমদ,আবু দাউদ,তিরমিযী]


ঋণের মাধ্যমে লাভ অর্জন

ইসলামে ঋণের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে সাহায্য করা, তাদের প্রতি দয়া করা তথা তাদের জীবন-যাপনে সহযোগিতা করা,সহযোগিতার আড়ালে সুবিধা অর্জন নয়। তাই বলা হয়েছে, ঋণের উদ্দেশ্য হবে আধ্যাত্বিক বৃদ্ধি বাহ্যিক বৃদ্ধি নয়। আর তা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এই কারণে ঋণ গ্রহীতা ঋণ ফেরত দেয়ার সময় যা নিয়েছে তা কিংবা সেই অনুরূপ ফেরত দিতে আদিষ্ট, অতিরিক্ত নয়। ঋণ দাতা এর অতিরিক্ত নিলে কিংবা ঋণ গ্রহীতা অতিরিক্ত ফেরত দিলে, তা সুদ হিসাবে গণ্য হবে। কারণ ফিক্হী মূলণীতিতে উল্লেখ হয়েছে,
[كل قرض جرّ نفعا فهو ربا]
‘কুল্লু কার্যিন র্জারা নাফ্আন ফাহুআ রিবা।’
অর্থাৎ প্রত্যেক ঋণ, যার মাধ্যমে লাভ উপার্জিত হয়, তা সুদ।
প্রকাশ থাকে যে, উপরোল্লেখিত ফিকহী মূলণীতিটি হাদীস হিসাবে যয়ীফ (দুর্বল)। দেখুন, ইরওয়াউল গলীল,আলবানী, নং ১৩৯৮। তবে কায়েদা ফিকহিয়্যাহ (ফিকহী মূলণীতি) হিসাবে স্বীকৃত।
ঋণের মাধ্যমে লাভের উদাহরণঃ
ক- কাউকে এক হাজার টাকা ধার দেওয়া এবং ফেরত নেওয়ার সময় বেশী নেওয়া। এটা স্পষ্ট।
খ- কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়া এই উদ্দেশ্যে বা এই শর্তে যে, ঋণ গ্রহীতা ঋণ দাতার কিংবা তার পরিবারের কাউকে চাকরি দিবে বা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।
গ- কাউকে ঋণ দেওয়া এই উদ্দেশ্যে যে, সে তাকে ঘর বা দোকান ভাড়া দিবে কিংবা এ ধরনের অন্য কিছু, যা সমাজের অনেকাংশে প্রচলিত।


ইসলামে উত্তম ঋণ পরিশোধ ব্যবস্থা এবং বর্তমান ব্যাংকিং প্রথা, একটি সংশয় নিরসন

ইসলাম ঋণ দেওয়াকে যেমন লোকের সাহায্য তথা তাদের কষ্ট দূরীকরণ হিসাবে স্বীকার করে, তেমন ঋণ পরিশোধে উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করে। তাই ঋণ গ্রহীতা ঋণ ফেরত দেয়ার সময় বেশি বা উত্তম ফেরত দিতে পারে, যাকে শরীয়তের পরিভাষায় ‘হুসনুল্ কাযা’ বা উত্তম পরিশোধ বলা হয়।
عن أبي رافع رضي الله عنه قال: استسلف رسول الله صلى الله عليه و سلم من رجل بكرا فقدمت عليه إبل من الصدقة فأمر أبا رافع أن يقضي الرجل بكره، فرجع إليه أبو رافع فقال: لم أجد فيها إلا خيارا رباعيا، فقال: أعطه إياه، إن خيار الناس أحسنهم قضاء" - رواه مسلم و أحمد
অর্থ, আবু রাফে হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা নবী (সাঃ) এক ব্যক্তি হতে একটি উষ্ট্রী ধার নেন। তার পর সাদাকার উট আসলে আবু রাফেকে আদেশ দেওয়া হয়, সে যেন সেই ব্যক্তির উট ফেরত দেয়। আবু রাফে (রাযিঃ) ফিরে এসে বলেঃ [সেই সমগুণের উট নেই বরং তার থেকে উত্তম] রুবায়ী মুখতার [এমন পুরুষ উট যা ছয় বছর বয়স অতিক্রম করে সপ্তম বছরে প্রবেশ করেছে এমন] উট আছে। নবী (সাঃ) বলেনঃ তাই দিয়ে দাও; কারণ ভাল মানুষ তারা যারা উত্তম পরিশোধকারী।” [মুসলিম, অধ্যায়ঃ বয়ূ, নং ৪১০৮]
অনেকে ইসলামের এই সুন্দর বিধান না বুঝতে পেরে, কিংবা না বোঝার ভান করে, কিংবা অপরিপক্ক জ্ঞানের কারণে কিংবা অন্তরে প্রবৃত্তির রোগ থাকার কারণে, বিষয়টিকে বর্তমান ব্যাংকিং প্রথায় অতিরিক্ত প্রদান করা ও অতিরিক্ত গ্রহণ করা বৈধ বলে ফতুয়া দিয়েছে। তাদের মন্তব্য, নবী (সাঃ) যেমন ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় বেশী দিলেন এবং ঋণ দাতা বেশী গ্রহণ করলেন, তেমন আমরা ব্যাংকে ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় যদি বেশী দেই এবং তারা সেটা গ্রহণ করে তো অবৈধতার কিছু নেই।
উত্তরে বলবো, নবী (সাঃ) এর ঋণ ফেরতে বেশি দেওয়া এবং বর্তমান যুগের ব্যাংকিং প্রথায় বেশী লেন-দেনের প্রথার মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান।
প্রথমতঃ নবী (সাঃ) কে ঋণ দাতা ঋণ প্রদানের সময় কোনো শর্ত দেয়নি যে, ঋণ ফেরত কালে বেশী ফেরত দিতে হবে। অন্যদিকে বর্তমান ব্যাংক সুক্ষ্ম হিসাবের মাধ্যমে বেশী দেওয়ার শতকরা হার নির্ধারণ করে দেয় এবং নির্ধারিত সময়ে তা ফেরত না দিতে পারলে শতকরা হার আরোও বৃদ্ধি পায়। আসলে ব্যাংক এই চক্রের মাধ্যমেই অর্থায়ন করে থাকে, আর আমরা বুঝেও বুঝি না।
দ্বিতীয়তঃ সমাজে এটা পরিচিত ছিল না যে,নবী (সাঃ) কে ঋণ দিলে তিনি অতিরিক্ত ফেরত দেন। বরং তিনি হঠাতই এই রকম আদেশ দেন। এই কারণে ইসলামী পন্ডিতগণের ঐক্যমত রয়েছে যে, যে কোনো ঋণে যদি বেশি ফেরতের শর্ত থাকে, তাহলে সেটা হারাম।
ইবনুল মুনযির বলেনঃ ‘তাদের ঐক্যমত রয়েছে যে, ঋণ দাতা যদি ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ ফেরতের সময় বেশী দেওয়া কিংবা হাদিয়া সহ ঋণ ফেরত দেওয়ার শর্ত দেয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ দেওয়া হয়, তাহলে বেশি নেওয়াটা সুদ।’ [মুগনী,৬/৪৩৬] তাই ঋণ ফেরতের সময় বেশি গ্রহণ বৈধ নয়, যতক্ষণে দুটি শর্ত না পাওয়া যায়।
ক- ঋণ দাতা ঋণ গ্রহীতার সাথে লাভ নেওয়ার শর্ত দেয় নি।
খ- সমাজে বেশি দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ও নয়।
যদি শর্ত দেওয়া হয় কিংবা এটা সমাজে প্রচলিত থাকে, তাহলে বেশি নেওয়া সুদ হবে। এখানে প্রচলিত শব্দটির উল্লেখ এই কারণে করা হচ্ছে যে, শারয়ী মূলণীতিতে প্রচলিত প্রথা শর্তর মতই। অর্থাৎ শর্তারোপ তো করে না কিন্তু প্রথা ও প্রচলন অনুযায়ী বেশি নেয় বা দেয়, তাহলে সেটা শর্ত হিসাবেই গণ্য হবে।


ঋণ পরিশোধে বিলম্ব না করা

ঋণ দাতা যখন মানুষের উপকার্থে ঋণ প্রদান করে, তখন ঋণ গ্রহীতার দ্বীনী ও নৈতিক দায়িত্ব হবে তা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া। যদি এইরকম না করে টাল-বাহানা শুরু করে, মিথ্যা ওজর পেশ করতে লাগে, তাহলেই আপসে মিল-মুহব্বত ও ভ্রাতৃত্ব নষ্ট হয়, শত্রুতা বৃদ্ধি পায় এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাস যোগ্যতা হারায়।
মহান আল্লাহ বলেনঃ "উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কি হতে পারে?" [সূরা আর রাহমান - ৬০]
তিনি অন্যত্রে বলেনঃ
( إن الله يأمركم أن تؤدوا الأمانات إلى أهلها )
"নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, হকদারদের হক তাদের নিকট পৌঁছে দিতে।" [ সূরা নিসা - ৫৮]
নবী (সাঃ) বলেনঃ “ধনী ব্যক্তির টাল-বাহানা করা অত্যাচার।” [মুত্তাফাকুন আলাইহ]
তিনি (সাঃ) আরো বলেনঃ
" من فارق الروح الجسد، و هو بريء من ثلاث دخل الجنة: من الكبر، والغلول، والدين" - رواه ابن ماجه
‘‘যে ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করল এমতাবস্থায় যে, সে তিনটি স্বভাব থেকে মুক্ত ছিল, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবেঃ অহংকার, গনীমতের সম্পদ হতে চুরি এবং ঋণ।” [ইবনু মাজাহ, আলবানী (রহঃ) সহীহ বলেছেন]


ঋণ পরিশোধের পূর্বে মৃত্যুবরণ

ঋণ মানুষের হক-পাওনা, তা পূরণের পূর্বে মৃত্যুবরণ করা মানে মানুষের হক নিজ স্কন্ধে থেকে যাওয়া, যা বড় অপরাধ। সেই কারণে এই প্রকার ব্যক্তির জানাযার নামায নবী (সাঃ) নিজে পড়েন নি। ইমাম তিরমিযী হাসান-সহীহ সনদে আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত করেন, নবী (সাঃ) এর কাছে একদা এক ব্যক্তির জানাযা নিয়ে আসা হলে, তিনি (সাঃ) বলেনঃ ‘‘তোমরা তোমাদের সাথীর জানাযা পড়; কারণ সে ঋণী।’’ [তিরমিযী, অধ্যায়ঃ জানাযা, নং১০৬৯]
এই কারণে ইসলামী পন্ডিতগণ বলেন, মাইয়্যেতের তারেকাহ (উত্তরাধিকার) বন্টণের পূর্বে কয়েকটি হক নির্ধারিত, তা পূরণের পরেই তার উত্তরাধিকার বন্টিত হবে। তন্মধ্যে মাইয়্যেতের উপর অপরের হক সমূহ অন্যতম। সেই হক আল্লাহর হোক, যেমন যাকাত কিংবা মানুষের হক হোক, যেমন ঋণ। [আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিক্হী, ড. ফাউযান/৩৩৪]


অভাবী ঋণীকে অবকাশ প্রদান

সমাজে যেমন কিছু লোক পাওয়া যায়, যারা সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ঋণ শোধ করতে ঢিলেমি করে, তেমন সত্যিকারে এমন লোকও রয়েছে যারা নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম। এই রকম ব্যক্তিকে ইসলাম অতিরিক্ত সময় দিতে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
( و إن كان ذو عُسرة فنظرة إلى ميسرة و أن تصدقوا خيرٌ لكم إن كنتم تعلمون)
"যদি ঋণী দরিদ্র হয়, তবে স্বচ্ছল অবস্থা আসা পর্যন্ত অবকাশ দিবে আর মাফ করে দেয়া তোমাদের পক্ষে অতি উত্তম, যদি তোমরা জানতে!" [ সূরা বাক্বারাহ - ২৮০]
নবী (সাঃ) বলেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, আল্লাহ তাকে কিয়ামত দিবসের কষ্ট থেকে নিষ্কিৃতি দিবে, সে যেন অভাবী ঋনীকে অবকাশ দেয় কিংবা তার ঋণের বোঝা লাঘব করে।” [মুসলিম, অধ্যায়, ক্রয়-বিক্রয়, নং ৪০০০]
এখানে একটি বিষয় বর্ণনা করা জরূরী মনে করছি, তা হল, ঋণ গ্রহীতা যদি নির্ধারিত সময়ে ঋণ ফেরত দিতে না পারে, তাহলে তাকে অবকাশ দিতে হবে বিনা লাভের শর্তে। কিন্তু যদি ঋণ দাতা তার মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় এবং এর বিনিময়ে লাভ নেয় তাহলে তা স্পষ্ট সুদ হবে। যেমন কেউ এক বছর পর তার ঋণ ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু বছর শেষ হলে সে ফেরত না দিতে পারায় ঋণ দাতার নিকট আরো ৫ মাস সময় বাড়িয়ে দেয়ার আবেদন করলো। অতঃপর ঋণ দাতা তাকে বললোঃ ঠিক আছে মেয়াদ বাড়াবো কিন্তু এর বিনিময়ে তোমাকে ঋণ ফেরতের সময় মূল ধনের বেশি দিতে হবে। অর্থাৎ সময় বৃদ্ধির বিনিময়ে লাভ গ্রহণ। এটা স্পষ্ট সুদ, যা নবী (সাঃ) এর যুগে আরবের জনপদে ছিল এবং তা এখনও বিদ্যমান। [আল্ মুলাখ্খাস আল ফিকহী, ড.ফাউযান /২৩৭]


ঋণ পরিশোধ না করার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ

আজ-কাল সমাজে আর এক প্রকার লোক দেখা যায়, যারা ঋণ নেয় পরিশোধ না করার উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ আসলে তার অন্তরে থাকে অন্যের অর্থ কৌশলে আত্মসাত করা। আর ঋণ করাটা হচ্ছে তার একটি বাহানা মাত্র। এই রকম লোকেরা এক সাথে কয়েকটি হারাম কাজে লিপ্ত হয়।
১ - বাতিল পদ্ধতিতে অন্যের মাল-সম্পদ ভক্ষণ, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। [বাক্বারাহ/১৮৮]
২ - ধোকা তথা প্রতারণা।
৩ - জেনে বুঝে সজ্ঞানে গুনাহ করা।
৪ - মিথ্যা বলা।
নবী (সাঃ) বলেনঃ
من أخذ أموال الناس يريد أداءها أدى الله عنه، و من أخذ يريد إتلافها أتلفه الله - رواه البخاري
অর্থ, ‘‘যে ব্যক্তি অন্যের মাল পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে নেয়, আল্লাহ তাআলা তার পক্ষ হতে পরিশোধ করে দেন। (পরিশোধ করতে সাহায্য করেন) আর যে ব্যক্তি তা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে নেয়, আল্লাহ তা নষ্ট করে দেন। [বুখারী, অধ্যায়ঃ ইস্তিকরায, নং২৩৮৭]
তাদের এই রকম জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকা উচিৎ। কারণ মানুষের এই হক পৃথিবীতে আদায় না করা হলেও আখেরাতে আল্লাহর দরবারে তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। বরং আল্লাহ তা নিজে আদায় করে দিবেন।


ঋণের যাকাত

অর্থাৎ কেউ কাউকে ঋণ দিলে এবং সেই ঋণ যাকাতের আওতায় পড়লে, যাকাত কাকে দিতে হবে? ঋণ গ্রহীতাকে যার কাছে সেই মাল আছে? না ঋণ দাতাকে? আসলে সেই অর্থ, দাতার নিকট থেকে গ্রহীতার কাছে স্থানান্তর হয়েছে মাত্র। নচেৎ প্রকৃতপক্ষে তার মালিক দাতাই। সেই কারণে ঋণ দাতাকেই সেই মালের যাকাত দিতে হবে। তবে ইসলামী গবেষকদের নিকট বিষয়টির একটু ব্যাখ্যা রয়েছে, তা হলঃ ঋণ গ্রহীতা যদি অভাবী হয়, যার কারণে সে সঠিক সময়ে ঋণ ফেরত দিতে অক্ষম কিংবা সক্ষম তবে টাল-বাহানাকারী , যার থেকে ঋণ আদায় করা কষ্টকর। এই ক্ষেত্রে ঋণ দাতার প্রতি সেই মালের যাকাত দেওয়া জরূরী নয়, যতক্ষণে তা তার হাতে না আসে। আর যদি ঋনী ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে সক্ষম হয় তথা সেই ঋণ পাওয়ার পুরো সম্ভাবনা থাকে, তাহলে যাকাতের সময় হলেই ঋণ দাতাকে তার যাকাত আদায় করতে হবে। [ফতোয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি, ৯/১৯১, ফতোয়া নং ৯০৬৯]
তবে টাল-বাহানাকারীর কাছ থেকে কয়েক বছর পর ঋণ পাওয়া গেলে বিগত সব বছরের যাকাত দিতে হবে না এক বছরের দিলেই হবে? এ ক্ষেত্রে উপরোক্ত ফাতাওয়া কমিটি এক বছরের দিলেই হবে বলে ফাতওয়া দিয়েছেন। [ ফাতাওয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি,৯/১৯০]


ঋণ হতে আশ্রয় প্রার্থনা এবং ঋণ পরিশোধের দুআ

নবী (সাঃ) ঋণ হতে আল্লাহর নিকট বেশি বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, যা দেখে এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেনঃ আল্লাহর রাসূল! আপনি ঋণ থেকে খুব বেশি বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করেন? নবী (সাঃ) বলেনঃ
" إن الرجل إذا غرم حدّث فكذب و وعد فأخلف" - رواه البخاري
“মানুষ ঋণী হলে, যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে এবং অঙ্গীকার করলে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে।” [বুখারী, অধ্যায়ঃ ইস্তিকরায, নং ২৩৯৭]
তাই তিনি (সাঃ) বলতেনঃ
" أللّهمَّ! إنّي أعوذُ بِكَ مِنَ الكَسَلِ والهَرَمِ والمأثَمِ والمَغْرَمِ" - رواه مسلم
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা! ইন্নী আউযুবিকা মিনাল্ কাসালি, ওয়াল্ হারামি, ওয়াল্ মা’ছামি, ওয়াল্ মাগ্রাম॥
অনুবাদঃ ‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় কামনা করছি অলসতা, অধিক বার্ধক্য, গুনাহ এবং ঋণ হতে।” [মুসলিম, অধ্যায়ঃ যিকর ও দুআ, নং৬৮৭১]
তিনি (সাঃ) আরো বলতেনঃ
" اللهم! إني أعوذ بك من الهم والحزن، والكسل، والبخل، والجبن، و ضلَع الدين، وغلبة الرجال" - رواه النسائي
উচ্চারণঃ “আল্লাহহুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিনাল্ হাম্মি ওয়াল্ হাযানি, ওয়াল্ আজ্যি ওয়াল্ কাসালি, ওয়াল্ বুখ্লি ওয়াল্ জুব্নি, ওয়া যালাইদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।”
অনুবাদঃ ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, চিন্তা-ভাবনা, অপারগতা,অলসতা, কৃপণতা এবং কাপুরুষতা থেকে। অধিক ঋণ থেকে এবং দুষ্ট লোকের প্রাধান্য থেকে।’ [নাসাঈ, অধ্যায়ঃ ইস্তিআযাহ, নং ৫৪৭৮]


লেখক: আব্দুর রাকীব মাদানী
লিসান্স: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, দাওয়াহ সেন্টার, খাফজী, সউদী আরব


কুরআন-হাদিসের আলোকে সুদের ক্ষতি-অপকার-কুপ্রভাব

                                                                  

                                                               

                                             সুদের ক্ষতি-অপকার-কুপ্রভাব

                                                                ভূমিকা

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, সুদ, সুদের অপকারিতা ও তার ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে বেশি বেশি আলোচনা হওয়া দরকার। কারণ যে সুদী কারবার করে সে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করে। আর কোনো মুসলমান এমনটি কল্পনাও করতে পারে না। তাই এ থেকে দূরে থাকতে প্রতিটি মুসলমানের জন্য সুদের বিধান ও তার প্রকার-প্রকরণ জানা অপরিহার্য।

এ গুরুত্ব বিবেচনা করেই আমি নিজের এবং আমার মতো জ্ঞানের দৈন্যতায় ভোগা মুসলিম ভাই-বোনদের জন্য সুদের বিধানাবলির ওপর কুরআন-হাদিসের দলিলাদি একত্রিত করেছি। বর্ণনা করেছি ব্যক্তি ও সমাজের ওপর এর কুপ্রভাবের দিকগুলোও।

এ গুরুত্ব বিবেচনা করেই আমি নিজের এবং আমার মতো জ্ঞানের দৈন্যতায় ভোগা মুসলিম ভাই-বোনদের জন্য সুদের বিধানাবলির ওপর কুরআন-হাদিসের দলিলাদি একত্রিত করেছি। বর্ণনা করেছি ব্যক্তি ও সমাজের ওপর এর কুপ্রভাবের দিকগুলোও।

আমি প্রথমে ভূমিকা তারপর তিনটি পর্ব এবং সবশেষে উপসংহার তুলে ধরে বইটির বিন্যাস করেছি এভাবে-

প্রথম পর্ব : প্রাক ইসলামি যুগে সুদ। এ পর্বে রয়েছে তিনটি অধ্যায়। যথা-
প্রথম অধ্যায় : রিবা বা সুদের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ।
দ্বিতীয় অধ্যায় : ইহুদি ধর্মে সুদ।
তৃতীয় অধ্যায় : জাহিলি যুগে সুদ।
দ্বিতীয় পর্ব : ইসলাম ধর্মে সুদের অবস্থান। এ পর্বে রয়েছে চারটি অধ্যায়। যথা-
প্রথম অধ্যায় : সুদ সম্পর্কে সতর্কিকরণ।
দ্বিতীয় অধ্যায় : রিবায়ে ফযল- (ক) রিবায়ে ফযল সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য। (খ) এর বিধান এবং রিবার সকল প্রকার। এবং (গ) রিবা হারাম হওয়ার কারণ ও হিকমত।
তৃতীয় অধ্যায় : রিবায়ে নাসিয়া। (ক) সংজ্ঞা (খ) রিবায়ে নাসিয়া সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য।
চতুর্থ অধ্যায় : বাইয়ে ইনা। (ক) সংজ্ঞা (খ) এর বিধান এবং তার নিন্দায় বর্ণিত কয়েকটি উদ্ধৃতি।
তৃতীয় পর্ব : যে সব ক্ষেত্রে কম-বেশি করা বা বাকি দেয়া জায়িয আছে। এ পর্বে রয়েছে তিনটি অধ্যায়। যথা-
প্রথম অধ্যায় : ওজন বা পরিমাপ করে বিক্রি হয় না এমন জিনিস কম-বেশি করে বেচা-কেনা বৈধ।
দ্বিতীয় অধ্যায় : বাইয়ে সরফ এবং তার বিধান।
তৃতীয় অধ্যায় : সন্দেহ থেকে দূরে থাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করণ।
চতুর্থ পর্ব : সমকালীন রিবার কতিপয় মাসআলার ব্যাপারে ফতোয়া।
পঞ্চম পর্ব : সুদের ক্ষতি ও অপকারিতা এবং তার কুপ্রভাব।
উপসংহার : এতে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল।

প্রথম পর্ব
প্রাক ইসলামি যুগে সুদ

প্রথম অধ্যায় : 'রিবা' বা সুদের শাব্দিক ও শরয়ি অর্থ।
দ্বিতীয় অধ্যায় : ইহুদি ধর্মে সুদ।
তৃতীয় অধ্যায় : জাহিলি যুগে সুদ।

প্রথম অধ্যায় : 'রিবা' বা সুদের শাব্দিক ও শরয়ি অর্থ

'রিবা'র আভিধানিক অর্থ : বৃদ্ধি করা। যেমন-আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
'অতঃপর যখনই আমি তাতে পানি বর্ষণ করি, তখন তা আন্দোলিত ও স্ফীত (বৃদ্ধি প্রাপ্ত) হয়।'[১] আরও ইরশাদ করেন-
'একদল অপর দলের চেয়ে বড় হবে।'[২] অর্থাৎ অধিক সংখ্যক। যেমন বলা হয় অমুকে অমুকের চেয়ে বেশি লাভ করেছে।[৩]
রিবার আসল অর্থ বৃদ্ধি : তা মূলে নয়তো মূলের বিনিময়ের মাঝে। যেমন এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম। আবার প্রত্যেক হারাম ও নিষিদ্ধ ব্যবসাকেও রিবা বলা হয়।[৪]

রিবার শরয়ি বা পারিভাষিক অর্থ

নির্দিষ্ট কয়েকটি জিনিসে কম-বেশি করা। দুই ধরনের রিবার ক্ষেত্রে এ সংজ্ঞা প্রযোজ্য। যথা- রিবাল-ফযল ও রিবান-নাসিয়া।

দ্বিতীয় অধ্যায় : ইহুদি ধর্মে সুদ।

ইহুদিরা সেই আদিকাল থেকেই ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশল প্রিয় জাতি হিসেবে প্রসিদ্ধ। তারা তাদের কাছে প্রেরিত নবীর বিরুদ্ধে নানা কূটচাল চালত। তাদের সেসব কূটকৌশলের একটি ছিল সুদ খাওয়ার ব্যাপারে কৌশলের আশ্রয় নেয়া। অথচ তাদের নবী এ থেকে তাদের বারণ করেছেন। হারাম ঘোষণা করেছেন সুদ খাওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
'সুতরাং ইয়াহুদীদের যুলুমের কারণে আমি তাদের উপর উত্তম খাবারগুলো হারাম করেছিলাম, যা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছিল এবং আল্লাহর রাস্তা থেকে অনেককে তাদের বাধা প্রদানের কারণে। আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।'[৫]

হাফেজ ইবনে কাসির রহ. বলেন, 'আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তথা ইহুদিদের সুদ খেতে নিষেধ করেন, তারপরও তারা সুদ খাওয়া থেকে বিরত থাকেনি। এজন্য তারা নানা কৌশল গ্রহণ করল। বিষয়টিকে সন্দেহের বাতাবরণে ঢেকে ফেলল আর মানুষের সম্পদ খেতে লাগল অবৈধ পন্থায়।'[৬]

ইহুদিরা সুদ হারাম ঘোষণাকারী বক্তব্যকেই বিকৃত করল। তারা সে বক্তব্যের ব্যাখ্যা দাঁড় করাল এভাবে, ইহুদিদের পরস্পরের মাঝে সুদ খাওয়া নিষেধ, তবে অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে ইহুদিদের সুদী কারবার করতে কোনো বারণ নেই। রাব নামক এক ইহুদি যাজক বলে, যখন কোনো খৃস্টানের দরকার পড়বে দিরহামের, ইহুদির উচিৎ হবে সর্বদিক থেকে এ সুযোগে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করা। তাকে আটকে ফেলা ব্যাপক লাভের বেড়াজালে। যাতে সে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয়। এবং তার সম্পদের মালিকানা খর্ব হয় কিংবা তার সম্পদ এবং ঋণ সমান্তরাল হয়ে যায়। এভাবে ইহুদি খৃষ্টান ব্যক্তির ওপর কর্তৃত্ব লাভ করবে অতপর বিচারকের সহযোগিতায় তার সম্পদের অধিকার কেড়ে নিতে সক্ষম হবে।[৭]

সুতরাং আল্লাহর বাণীর আলোকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তিনি তাওরাত গ্রন্থেই ইহুদিদের ওপর সুদ হারাম করেছেন। তারা আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছে এবং কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাঁর বাণীর বিকৃতি সাধন করেছে। তারা মনগড়া ব্যাখ্যা স্থির করেছে যে, হারাম শুধু ইহুদিদের পরস্পরের মাঝে সুদী লেনদেন করা অন্যথায় অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে সুদী কারবার করা হারাম নয়। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে তাদের ভর্ৎসনা করেছেন। যেমনটি জানা গেল উপরের আয়াত থেকে।

তৃতীয় অধ্যায় : জাহিলি যুগে সুদ

জাহিলি যুগে সুদের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। এমনকি তারা তাদের ধারণা মতে এটাকে বিশাল লাভ হিসেবে গণ্য করত। ইমাম তাবারি রহ. তদীয় তাফসির গ্রন্থে ইমাম মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন, জাহিলি যুগে তারা এমন ছিল যে, কারও ওপর কারও ঋণ থাকলে সে বলত, 'আমি তোমার পাওনা অর্থ আরও পরে শোধ করব, বিনিময়ে এ পরিমাণ অর্থ পাবে। এতে সে সম্মত হয়ে যেত।[৮]

জাহিলি যুগের লোকদের অভ্যাস ছিল, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতাকে জিজ্ঞেস করত, তুমি কি এখন ঋণ পরিশোধ করবে নাকি বেশি দেয়ার শর্তে আরও সময় নেবে ? ঋণ পরিশোধ না করলে তার ওপর বৃদ্ধির হার ধার্য করে দিত। আর ঠিক করে দিত নতুন মেয়াদ।

জাহিলি যুগে চক্রবৃদ্ধি সুদ যেমন ছিল নগদ অর্থে, গবাদি পশুর ওপরও তেমনি প্রচলিত ছিল বাৎসরিক সুদ। যদি কারও কাছে কারও ঋণের অতিরিক্ত পাওনা থাকত সে মেয়াদ পূর্ণ হওয়া মাত্র তার কাছে এসে বলত, 'তুমি কি ঋণ শোধ করে দিবে নাকি অতিরিক্তসহ পরে দেবে ? যদি সে দিতে পারত দিয়ে দিত; নয়তো সে তার কাছে সেই উট দিত যা তার পাওনা উটের চেয়ে এক বছরের বড়। যদি তার পাওনা হত বিনতে মাখায বা এক বছরের উট সে দিত বিনতে লাবুন বা দুই বছরের উট। অতপর তার কাছে দ্বিতীয় বছর পাওনা চাইতে আসলে না দিতে পেরে হিক্কা দিত তৃতীয় বছরে। এ মেয়াদ শেষ হলে সে এলে তাকে জিযআ বা চার বছরের উট দিত। এভাবে ওপরে উঠতে উঠতে ঋণদাতা বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে যেত। অষ্টম বছরে তার কাছে এলে যখন সে তাও পরিশোধ না করতে পারত পরের বছর তাকে দ্বিগুণ দিত। সে বছর না দিতে পারলে তারও দ্বিগুণ দিত। যখন একশতটি হত তখন দুইশতটি দিতে হত। এ বছর দিতে না পারলে পরের বছর তাকে চারশ'টি দিতে হত। আল্লাহ তাআলা এদের কথাই বলেছেন কুরআনে কারিমে- 'হে মুমিনগণ, তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।'[৯]

সুতরাং জানা গেল জাহিলি যুগে সুদকে ওই সব লাভের মধ্যে গণ্য করা হত সম্পদের মালিক যা ভোগ করে। এ ব্যাপারে সে অন্য ভাইয়ের প্রতি লক্ষ্য করে না যে, সে লাভবান হল নাকি ক্ষতিগ্রস্ত ? সে গরিব হয়ে গেল নাকি ধনী ? দৃষ্টি শুধু এক দিকেই থাকে- বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া। এতে অন্য কেউ ধ্বংসের মুখে পড়লেও তা দেখার বিষয় নয়। তারা এমন করত তাদের অমানবিক আচরণ এবং নষ্ট চরিত্র বলেই। তাদেরকে যে চরিত্র দিয়ে পাঠানো হয়েছে তা বিকৃত হওয়ার ফলেই। এ জন্যই তাদের সমাজে কুকর্ম ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিল। ছিল না সেখানে অন্যের সম্মান। ছোটরা বড়দের সম্মান দিত না। বড়রাও ছোটদের স্নেহ করত না। ধনীরাও দেখাত না গরিবদের প্রতি কোনো মমতা। সমাজের সবাই ছিল অনাচার ও হট্টগোলে দিশেহারা। আর সবচে' আফসোসের বিষয় হলো, এ সুদ শুধু জাহিলি যুগেই সীমাবদ্ধ থাকে নি বরং ইসলামি সমাজ বলে দাবিদার পরিমণ্ডলেও তা ঢুকে পড়েছে অনায়াসে- যারা দাবি করে যে তারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করেছে ! এ জন্য প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য আল্লাহর নির্দেশ পালন করা এবং সত্যিকারার্থেই তাঁর আইন প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হওয়া। তবে যারা মুসলমান হিসেবে দাবি করার পরও সুদী কারবার করেন তাদেরকে বিনীত উপদেশ দান ও এ বিশাল অপরাধ থেকে সতর্ক করার সঙ্গে সঙ্গে এও বলব যে, চিন্তা করে দেখুন আপনারা কি প্রাক কুরআন নাজিল যুগে ফিরে যাননি ? প্রত্যাবর্তন করেননি কি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমন পূর্ব কালের সেই নির্দয় অসভ্য সমাজে ?

দ্বিতীয় পর্ব
ইসলামে সুদের অবস্থান

এ পর্বে রয়েছে চারটি অধ্যায়। যথা-
প্রথম অধ্যায়: সুদ সম্পর্কে সতর্কিকরণ।
দ্বিতীয় অধ্যায়: রিবায়ে ফযল এবং- (ক) রিবায়ে ফযল সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য। (খ) এর বিধান এবং রিবার সকল প্রকার। ও (গ) রিবা হারাম হওয়ার কারণ ও রহস্য।
তৃতীয় অধ্যায়: রিবায়ে নাসিয়া। এবং- (ক) সংজ্ঞা এবং (খ) রিবায়ে নাসিয়া সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য।
চতুর্থ অধ্যায়: বাইয়ে ইনা। এবং- (ক) সংজ্ঞা এবং (খ) এর বিধান এবং তার নিন্দায় বর্ণিত কয়েকটি উদ্ধৃতি।

প্রথম অধ্যায় : সুদ সম্পর্কে সতর্কিকরণ

রিবা বা সুদ থেকে সতর্ক করে কুরআন ও সুন্নায় অনেক বক্তব্য এসেছে। আর কুরআন-সুন্নাহ যেহেতু শরিয়তের এমন প্রধান দুই উৎস যে, এ দুটোকে যে অবলম্বন করবে; এতদুভয়ের অনুসরণ ও আনুগত্য করবে, সে হবে কামিয়াব; চির সফল। যে মুখ ফিরিয়ে নিবে তার জন্য রয়েছে এক সংকুচিত জীবন তদুপরি কিয়ামতে তাকে উঠানো হবে অন্ধ হিসেবে।

১. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- 'যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।[১০]

২. আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদাকাকে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অতি কুফরকারী পাপীকে ভালবাসেন না।[১১]

৩. হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলম করবে না এবং তোমাদের যুলম করা হবে না।'[১২]

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এটি শেষ আয়াত যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম-এর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল।[১৩]

৪. আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেন- 'হে মুমিনগণ, তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।'[১৪]

৫. আল্লাহ তাআলা সুদ হারাম করেন আর ইহুদিরা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে সুদ বৈধ করার চেষ্টা করে, সেদিকে ইঙ্গিত করে মহান বর বলেন- 'আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।'[১৫]

৬. 'আর তোমরা যে সুদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তা মূলতঃ আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে (তাই বৃদ্ধি পায়) এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত।'[১৬]

৭. জাবির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদদাতা, গ্রহীতা এবং এর লেখক ও সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ দিয়েছেন।'[১৭]

৮. সামুরা বিন জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'রাতে আমি দেখলাম, দু'জন লোক এসে আমার কাছে এলো। তারা আমাকে এক পবিত্র ভূমির দিকে নিয়ে গেল। আমরা চলছিলাম, সহসা এক রক্ত নদীর পাড়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম যার মাঝে দণ্ডায়মান এক ব্যক্তি। নদীর মাঝখানে এক ব্যক্তিকে দেখা গেল। সামনে তার পাথর। মাঝের লোকটি নদী পেরুনোর জন্য যেই সামনে অগ্রসর হয়, পাথর হাতে দাঁড়ানো ব্যক্তি অমনি তার মুখে পাথর মেরে তাকে পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে দেয়। এভাবে যখনই সে নদী পেরিয়ে আসতে চায়, লোকটি তখনই তার মুখে পাথর মেরে পেছনে ঠেলে দেয়। আমি বললাম, ব্যাপার কী ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম বললেন, আমি যাকে নদীর মধ্যখানে দেখেছি সে সুদখোর।'[১৮]

৯. আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'ধ্বংসকারী সাতটি জিনিস থেকে বেঁচে থাক। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, সেগুলো কী কী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, শিরক করা, যাদু করা, অনুমোদিত কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের মাল ভক্ষণ করা, জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং সতী সরলা মুমিনা নারীকে ব্যাভিচারের অপবাদ দেয়া।'[১৯]

১০. ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'সুদের অর্থ দিয়ে যা-ই বৃদ্ধি করুক না কেন অল্পই কিন্তু তার শেষ পরিণাম।'[২০]

১১. সালমান বিন আমর তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে বিদায় হজে আমি বলতে শুনেছি, তিনি বলেন- 'মনে রেখ জাহিলি যুগের সকল সুদ ভিত্তিহীন। তোমাদের জন্য শুধুই মূলধন। তোমরা জুলুম করবেও না এবং সইবেও না।'[২১]

এ হাদিসে জাহিলি যুগের প্রচলিত রীতিগুলোকে ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছে। যদি অমুসলিম ব্যক্তি তার ইসলাম পূর্ব সময়ে লাভ হিসেবে সুদের পাওনাদার হয়। অতপর সে অর্থ গ্রহণের আগেই ইসলামে প্রবেশ করে। তবে শুধু তার মালের মূল অংশ গ্রহণ করবে; লাভটুকু ছেড়ে দিবে। আর ইসলামের আগে এ ধরনের যে কারবারগুলো হয়েছে ইসলাম সে ব্যাপারে ক্ষমা ঘোষণা করেছে। সুতরাং তাদেরকে অতীত কারবার সম্পর্কে কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। ইসলাম অতীত ক্ষমা করে দিয়েছে। কারণ, ইসলাম পূর্বকৃত সকল গুনাহ মাফ করে দেয়।[২২]

১২. আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'এমন এক সময় উপস্থিত হবে যখন লোকেরা পরোয়া করবে না সম্পদ হালাল নাকি হারাম উপায়ে অর্জিত।'[২৩] নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন সংবাদ দিয়েছেন মানুষকে সম্পদের ফিতনা থেকে বাঁচানোর জন্য। তিনি এমন সংবাদ দিয়েছেন যা তাঁর যুগে ছিল না। এ ধরনের ভবিষ্যৎবাণী তাঁর নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণও বটে।[২৪]

১৩. আবি জুহায়ফা রা. তদীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, 'নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রক্ত ও কুকুরের মূল্য নিতে এবং দাসীর উপার্জন গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। অভিশাপ দিয়েছেন উল্কি অঙ্কনকারী, উল্কি গ্রহণকারী এবং সুদ গ্রহীতা ও সুদদাতাকে। আরও অভিশাপ দিয়েছেন তিনি চিত্রাঙ্কনকারীকে।'[২৫]

১৪. আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'সুদের তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে। সর্বনিম্নটি হলো নিজের মায়ের সঙ্গে জেনা করার সমতুল্য। আর অপর ভাইয়ের সম্মান নষ্ট করা সবচে' নিকৃষ্ট সুদ।[২৬]

১৫. ফেরেশতা কর্তৃক গোসল করার সৌভাগ্যধন্য হানযালা তনয় আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'জেনে বুঝে এক দিরহাম পরিমাণ সুদ খাওয়া ছত্রিশবার জেনা করার চেয়েও বড় অপরাধ।[২৭]

১৬. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'যখন কোনো জনপদে সুদ ও ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ে তখন তারা নিজেদের ওপর আল্লাহর আজাব বৈধ করে নেয়।[২৮]

দ্বিতীয় অধ্যায় : রিবায়ে ফযল

রিবায়ে ফযল সম্পর্কে বর্ণিত কতিপয় হাদিস-

১) আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'তোমরা কমবেশি করে স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করো না। হ্যা, সমান সমান বিক্রি করতে পার। তোমরা কমবেশি করে রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বিক্রি করো না। হ্যা, সমান সমান বিক্রি করতে পার। তোমরা এসব জিনিসে বাকির বিনিময়ে নগদে বিক্রি করো না।' [২৯]

২) উসমান বিন আফ্‌ফান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'তোমরা এক দিনারের বিনিময়ে দুই দিনার অথবা এক দিরহাম দুই দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করো না।'[৩০]

৩) আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'সোনার বদলে সোনা, রুপার বদলে রুপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর এবং লবণের বদলে লবণ বিক্রি করো নগদ নগদ এবং সমান সমান। যে বেশি দিবে অথবা বেশি নিবে সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। দাতা -গ্রহীতা এক্ষেত্রে সমান অপরাধী।'[৩১]

৪) উবাদা বিন সামেত রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'সোনার বদলে সোনা, রুপার বদলে রুপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর এবং লবণের বদলে লবণ বিক্রি করো নগদ নগদ এবং সমান সমান। তবে যখন এসব জিনিসের প্রকার পরিবর্তন করা হবে তো যেভাবে ইচ্ছে বিক্রি করো। যখন তা হবে নগদ নগদ।'[৩২]

৫) মা'মার বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত যে, তিনি নিজ গোলামের হাতে এক সা পরিমাণ গম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, যাও এটি বিক্রি করো এবং এর বিনিময়ে যব কিনে আনো। গোলাম চলে গেল এবং এক সা' ও তার অতিরিক্ত কিছু নিল। যখন সে মা'মারের কাছে এসে এ সংবাদ দিল তখন তিনি বললেন, এমন করেছ কেন ? তুমি আবার বাজারে যাও। আর মনে রেখ কমবেশি করে নিবে না। কেননা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, খাবারের বদলে খাবার বিক্রি করতে হবে সমান সমান। তিনি বলেন, সেদিন আমাদের খাবার ছিল যব। তাকে বলা হলো, এটাতো একই জাতের খাদ্য নয়। তিনি বললেন, আমি এটাতেও সমান হওয়ার আশংকা করছি।[৩৩]

এ হাদিসের ওপর ভিত্তি করে ইমাম মালেক রহ. মনে করেন, গম এবং যব একই জাতের খাদ্য যাতে কম-বেশি করে কেনাবেচা বৈধ নয়। তবে জমহুর উলামার মত অন্যরকম। তারা বলেন, গম এক জাতীয় শস্য আর যব অন্য জাতের শস্য। সুতরাং এদুয়ের মাঝে কমবেশি করে কেনাবেচা জায়িয আছে, যখন তা হবে নগদে। যেমন- গমের বদলে চাল ক্রয় ইত্যাদি। জমহুরের দলিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর উক্তি- 'যদি এসব জিনিসের মধ্যে জাত পরিবর্তন হয় তবে যেভাবে ইচ্ছে কেনাবেচা করতে পার- যখন তা হবে নগদ মূল্যে।[৩৪]

তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর উক্তি 'গমের বদলে যব বিক্রি করতে কোনো সমস্যা নেই এমনকি যব বেশি হলেও; যখন তা হবে নগদে। তবে বাকিতে হলে সেটা ভিন্ন কথা।[৩৫] আর মা'মার বর্ণিত হাদিসের উত্তরে বলা হবে, এতে মালেকের রহ. পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। কারণ এতে তিনি স্পষ্ট বলেন নি যে, যব আর গম একই শ্রেণিভুক্ত শস্য। তদুপরি তিনি ভয় করেছেন- সেটা তার ব্যক্তিগত তাক্‌ওয়ার ব্যাপার।[৩৬] এরপর আশা করা যায় আর কোনো শংসয় থাকবে না। যব এক স্বতন্ত্র জাত আর গম অন্য এক জাত। সুতরাং এ দুটির মাঝে কমবেশি করে কেনাবেচা বৈধ যখন তা হবে নগদে এবং বিক্রিত দ্রব্য হস্তান্তর হবে চলমান বৈঠক ভাঙ্গার আগেই।

৬) সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব জানান, তাকে আবু হোরায়রা এবং আবু সাইদ রা.বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনি আদি আনসারির ভাইকে খায়বরের আমলা হিসেবে প্রেরণ করেন। একবার তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে 'জানিব'[৩৭] খেজুর নিয়ে আসেন। পয়গাম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, খায়বরের সব খেজুরই কি এমন ? তিনি আরজ করলেন, জি না, হে আল্লাহর নবী, আমরা বরং এক সা' 'জানিব' ক্রয় করি দুই সা' 'জামা'[৩৮] খেজুরের বিনিময়ে। এতদশ্রবণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, 'তোমরা এমনটি করো না। বরং সমান সমান বিক্রি করো নয়তো মন্দ জাতের খেজুর বিক্রি করো তারপর সে মূল্য দিয়ে উন্নত জাতের খেজুর কেনো। এটাই ইনসাফের দাবি।'[৩৯]

৭) আবু সাইদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন বেলাল রা. কিছু 'বারনি' খেজুর নিয়ে এলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা দেখে বললেন, কোত্থেকে নিয়ে এলে এসব ? বেলাল রা. উত্তর দিলেন, আমার কাছে কিছু খারাপ খেজুর ছিল। সেগুলো দুই সা' দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর জন্য এর এক সা' কিনেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হায়! একি করেছ ? এটাতো খাঁটি সুদ। তুমি আর এমন করেবে না। যখন কিনতে চাইবে, আলাদাভাবে আগে সেটা বিক্রি করবে। তারপর সেই মূল্য দিয়ে এটা কিনবে।[৪০]

৮) আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবদ্দশায় 'জামা' খেজুর খেতাম। আর জামা হলো বিভিন্ন মানের মিশ্রিত খেজুর। আমরা সেসবের এক সা' কিনতাম দুই সা'র বিনিময়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে যখন এ সংবাদ পৌঁছল তিনি বললেন, দুই সা' খেজুরের বিনিময়ে এক সা' খেজুর কেনা যাবে না, দুই সা' গমের বিনিময়ে এক সা' গম কেনা যাবে না এবং দুই দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহাম কেনা যাবে না।[৪১]

৯) ফুযালা বিন উবাইদুল্লাহ আনসারি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খায়বরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে গনিমতের মাল উপস্থাপনকালে স্বর্ণ ও ছোট দানা খচিত একটি হার সামনে এলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হার থেকে স্বর্ণ আলাদা করার নির্দেশ দিলেন। অতপর তিনি তাদের বললেন, সমান সমান ছাড়া স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করা না।'[৪২]

১০) ফুযালা রা. থেকে আরও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, খায়বর বিজয়ের দিন আমি বারো দিরহামের বিনিময়ে একটি হার কিনলাম যাতে স্বর্ণ এবং ছোট দানা ছিল। পরে আমি সেগুলো আলাদা করে বারো দিরহামের বেশি পেলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে যখন এ বিবরণ শুনালাম তিনি বললেন, 'স্বর্ণ ততক্ষণ পর্যন্ত বিক্রি করা উচিৎ নয় যাবৎ না তার থেকে অন্য জিনিস আলাদা করা হয়।'[৪৩]

এ হাদিস থেকে জানা গেল স্বর্ণের বিনিময়ে অন্য জিনিসসহ স্বর্ণ বেচাকেনা জায়িয নেই যতক্ষণ না অন্য জিনিস স্বর্ণ থেকে পৃথক করা হয়। পৃথক করে স্বর্ণের বদলে স্বর্ণ কিনতে হবে একদম সমান সমান। আর অন্য জিনিস যা দিয়ে ইচ্ছে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। তেমনি রুপাকেও রুপার বিনিময়ে অন্যবস্তু সমেত বিক্রি করা জায়িয নেই, গম বিক্রি করা জায়িয নেই অন্য জিনিসসহ গমের বিনিময়ে এবং লবণ বিক্রি করা জায়িয নেই অন্যকিছুর সঙ্গে লবণের বিনিময়ে। এভাবে সুদ হয় এমন প্রত্যেক বস্তুই অন্য জিনিসসহ বিক্রি করা জায়িয নেই; যতক্ষণ না সেটাকে আলাদা করা হয়।

(খ) সুদের বিধান :

ইমাম নাববি রহ. বলেন, 'সুদ হারামের ব্যাপারে সকল মুসলিম একমত; যদিও এর সংজ্ঞা ও মূলনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে।[৪৪] আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদ হারামের ক্ষেত্রে ছয়টি জিনিসের নাম নির্দিষ্ট করেছেন। সেগুলো হলো, সোনা, রুপা, গম, যব, খেজুর ও লবণ।

আসহাবে জাহিরি বলেছেন, এ ছয়টি জিনিসের বাইরে কোনো কিছুতে সুদ নেই। প্রমাণের ক্ষেত্রে তাদের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণের সনাতন যে নীতি রয়েছে তারই ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত তাদের।

আসহাবে জাহিরি বাদে অন্যরা বলেছেন, সুদ এ ছয়টি জিনিসেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এ ছয়টির কারণের মধ্যে যা যা অন্তর্ভুক্ত সবগুলোর হুকুম অভিন্ন। তবে তারা মতবিরোধ করেছেন এ ছয় ধরনের জিনিসে বিদ্যমান হারাম হওয়ার ইল্লত বা কারণ নিয়ে।

ইমাম শাফেয়ি রহ. মনে করেন, সোনা এবং রুপায় 'ইল্লত' হলো এদুয়ের মূল্যমান। তাই পরিমাপযোগ্য ও অন্যান্য জিনিস এ দুয়ের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হবে না ইল্লত অনুপস্থিত থাকার কারণে। আর বাকি চার জিনিসে ইল্লত হলো, এসবের খাদ্য জাতীয় হওয়া। এ জন্য প্রত্যেক খাদ্যদ্রব্যই সুদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।

ইমাম মালেক রহ. সোনা ও রুপার ক্ষেত্রে ইমাম শাফেয়ির সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। তবে অবশিষ্ট চারটির ব্যাপারে বলেছেন এসবের মধ্যে ইল্লত হলো, এসবের সংরক্ষণ এবং খাবারযোগ্য হওয়া।

ইমাম আবু হানিফার রহ. মতে সোনা ও রুপার ইল্লত মওযুনি বা ওজনযোগ্য হওয়া আর বাকি চারটির ইল্লত মাকিলি বা (শস্যের) পরিমাপযোগ্য হওয়া। সুতরাং প্রত্যেক মাকিলি এবং মওযুনি বস্তুতেই সুদের এ বিধান প্রযোজ্য।

সাইদ বিন মুসাইয়াব এবং ইমাম আহমদ ও শাফেয়ির পুরাতন মতানুসারে চারটির ইল্লত হলো একই সঙ্গে ওজন ও খাদ্য জাতীয় হওয়া।[৪৫]

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, 'সকল সাহাবি, তাবেয়ি এবং ইমাম চতুষ্টয় একমত যে, সোনা, রুপা, গম, যব, খেজুর এবং আঙ্গুর সমগোত্রের সামগ্রীর বিনিময়ে কেবল সমান সমান বিক্রি জায়িয। কেননা কমবেশি করা অবৈধ সম্পদ ভক্ষণের নামান্তর।[৪৬]

উলামায়ে কিরাম একমত যে, রেবা জাতীয় দ্রব্যকে তার সমগোত্রীয় দ্রব্যের বিনিময়ে বিক্রি বৈধ নয় যখন এক তরফে বাকি থাকে। তারা আরও একমত যে, একই গোত্রভুক্ত দ্রব্যকে নগদে কমবেশি করে বিক্রি করা বৈধ নয়। যেমন- সোনার বদলে সোনা বিক্রির সময়। তেমনি তারা একমত যে, একই জাতীয় দ্রব্যের বিনিময়ে বিক্রির সময় পণ্য হস্তগত করা পর্যন্ত ক্রয় মজলিস ত্যাগ করা বৈধ নয়। যেমন- সোনার বদলে সোনা, খেজুরের পরিবর্তে খেজুর অথবা অন্য জাতীয় তবে একই ইল্লত বিশিষ্ট জিনিস যেমন- সোনার বিনিময়ে রুপা এবং গমের বিনিময়ে যব। (এমন কেনাবেচার সময় হস্তগত হওয়ার আগে মজলিস ত্যাগ করা বৈধ নয়।)[৪৭]

ইমাম ইবনে কুদামা সুদের বিধান সম্পর্কে বলেছেন, 'এটি কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমার দ্বারা প্রমাণিত হারাম।[৪৮]

সারকথা, সোনা এবং রুপায় সুদের হুকুম বর্তানোর কারণ এর মূল্যমান সমৃদ্ধ হওয়া আর বাকি চারটি এ জন্যে যে পরিমাপ, ওজন ও ভক্ষণযোগ্য। যেমন-গম, যব, চাল ইত্যাদি। আর যা ওজন, মাপ বা ভক্ষণ কোনো জাতীয়ই নয় তদুপরি বিক্রি হয় অন্য জাতীয় জিনিসের বিনিময়ে সেটাতে কোনো সুদ নেই। এমনটিই বলেছেন অধিকাংশ উলামা। যেমন-(আংটির) পাথর, (খেজুরের) বীচি ইত্যাদি।

সুদ হারাম হওয়ার কারণ এবং হিকমত :

মুমিন মাত্রেই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলা এমন কিছুর নির্দেশ দেন না বা এমন কিছু থেকে বারণ করেন না যাতে কোনো না কোনো হিকমত বা নিগূঢ় রহস্য লুকায়িত থাকে নেই। আমরা যদি সে রহস্য জানতে পারি তাহলে তা আমাদের জন্য অতিরিক্ত অর্জন। যদি না জানি তবে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। আমাদের কাম্য ও কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ ও রাসূল সা. যা করতে বলেন তা সম্পাদন করা আর যা বারণ করেন তা থেকে বিরত থাকা। সুদ হারাম হওয়ার পশ্চাতে যেসব কারণ ও হিকমত কার্যকর তার কয়েকটি এই -
১. সুদ এক ধরনের জুলুম আর আল্লাহ তাআলা জুলুম হারাম করেছেন।
২. অসুস্থ হৃদয়ের মালিকদের প্রতারণার রাস্তা বন্ধ করে দেয়া।
৩. সুদের মধ্যে প্রতারণা রয়েছে।
৪. পণ্যের মান ধরে রাখা।
৫. সুদ আল্লাহ প্রবর্তিত পদ্ধতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।[৪৯]

তৃতীয় অধ্যায়: রিবায়ে নাসিয়া

(ক) রিবায়ে নাসিয়ার সংজ্ঞা:
জাহিলি যুগে এমন প্রচলন ছিল, একজন অপরজনকে নির্দিষ্ট মেয়াদের ওপর অর্থ ঋণ দিত এ শর্তে যে, প্রতি মাসে তাকে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দিতে হবে। অথচ মূল অর্থ আপনাবস্থায় বহাল থাকবে (কমবে না)। যখন সে মেয়াদ পুরা হবে; ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছে মূল অর্থ ফেরত চাইবে। যদি সে পরিশোধ করতে অক্ষম হয়, তাহলে মেয়াদ পুনঃনির্ধারণ করে মাসিক প্রদেয় অর্থের পরিমাণও বাড়িয়ে দিবে। সুদের এ প্রকার যদিও 'রিবাল ফযল' এর সংজ্ঞায় পড়ে তথাপি তার নাম দেয়া হয়েছে নাসিয়া এ জন্য যে, এতে নাসিয়া বা বাকিই মূল উদ্দেশ্য।

ইবনে আব্বাস রা. রিবায়ে নাসিয়া ছাড়া অন্য কোনো প্রকারকে সুদ বলতেন না এ বলে যে, নাসিয়া-ই তখন সমাজে প্রচলিত ছিল।[৫০]

অবশ্য একটু পরেই আমরা তাঁর এ মত প্রত্যাহার করে অন্যান্য সাহাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নাসিয়া, ফযল- সব রিবা হারামের পক্ষাবলম্বনের প্রমাণাদি তুলে ধরব। তারপর আর এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। (সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য।)

(খ) রিবায়ে নাসিয়া সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য :
রিবায়ে নাসিয়া সম্পর্কে সমগ্র উম্মাহ একমত হলেও রিবায়ে ফযল সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রা. এবং অন্যান্য সাহাবির মাঝে মতবিরোধ হয়। পরে তিনিও তাঁর মত থেকে ফিরে আসেন এবং সকল সাহাবির সঙ্গে রিবাল ফযল হারাম হওয়ার ব্যাপারে একমত হন। রিবান নাসিয়া হারাম হওয়াটা কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।

আবু সালেহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু সাইদ খুদরি রা. কে বলতে শুনলাম, 'দিনার দিনারের বিনিময়ে এবং দিরহাম দিরহামের বিনিময়ে সমান সমান বিক্রি করতে হবে। যে কমবেশি করবে সে সুদ খাওয়ার অপরাধ করল। আমি তাঁকে বললাম, ইবনে আব্বাস রা. অন্য কথা বলছেন। তিনি (আবু সাইদ খুদরি রা.) বললেন, আমি ইবনে আব্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি যা বলছেন তা কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর মুখ থেকে শুনেছেন নাকি কুরআনে পেয়েছেন ? তিনি উত্তর দিলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর মুখেও শুনি নাই বা কুরআনেও পাইনি। তবে উসামা বিন যায়েদ আমাকে বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'রিবা নাসিয়া বা বাকিতেই।'[৫১]

ইবনে আব্বাসের অপর বর্ণনায় রয়েছে, উসামা বিন যায়েদ আমাকে শুনিয়েছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'সাবধান, নিশ্চয় সুদ হলো (নাসিয়া) বাকিতে।'[৫২]

ইমাম নাবাবি রহ. বলেন, ইবনে আব্বাস এবং ইবনে উমর রা. এর কথার ভিত্তি ছিল উসামা বিন যায়েদ রা. এর হাদিস 'রিবা নাসিয়া বা বাকিতেই।' অতপর তাঁরা উভয়ে নিজেদের মত থেকে ফিরে এসেছেন। তাদের কাছে যখন মুসলিম শরিফে বর্ণিত আবু সাইদ খুদরির রা. হাদিস পৌঁছে তখন তাঁরাও আলোচ্য বস্তুগুলোকে একই জাতীয় বস্তুর বিনিময়ে কমবেশি করে কেনাবেচা হারাম বলে মেনে নেন। ইমাম মুসলিম সংকলিত হাদিসগুলো থেকে বুঝা যায়, তাঁদের কাছে নাসিয়া বা বাকিতে ছাড়া নগদেও যে কমবেশি করে বিক্রি করা নিষেধ সে হাদিস পৌঁছেনি। যখন পৌঁছেছে তখন তাঁরা নিজেদের মত থেকে ফিরে এসেছেন।

আর উসামা বিন যায়েদের হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এসব হাদিস দ্বারা তার হাদিস মনসুখ (রহিত) হয়ে গেছে। আর মুসলিম উম্মাহ যেহেতু এ হাদিসের ওপর আমল করেন না তাই বুঝা যায় এটি মনসুখ হয়ে গেছে।[৫৩]

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেছেন, 'উসামা রা. বর্ণিত হাদিসের শুদ্ধতার ব্যাপারে আলেমগণ একমত। তবে অন্যান্য হাদিসের সঙ্গে এর সমন্বয় করতে গিয়ে তাঁরা দ্বিমত করেছেন। বলা হয়েছে, হাদিসটি মনসুখ অথচ সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে কখনো মনসুখ প্রমাণিত হয় না। আবার বলা হয়েছে, হাদিসে 'لاربا' বা 'নাসিয়া ছাড়া বাকিতে রিবা নাই' বলে বুঝানো হয়েছে নাসিয়ার চেয়ে কঠিন শাস্তিযোগ্য কোনো রিবা নেই। যেমন- আরবরা বলে, 'জায়েদ ছাড়া শহরে কোনো জ্ঞানী নাই।' অথচ সে শহরে অনেক বিদ্বান রয়েছেন। কারণ এমন বলার উদ্দেশ্য, এর চেয়ে বড় নেই সেটা বুঝানো; একেবারে নেই তা বুঝানো উদ্দেশ্য নয়। দ্বিতীয়ত উসামা রা. এর হাদিস দ্বারা রিবায়ে ফযল হারাম না হওয়া বুঝা যায় পরোক্ষভাবে। পক্ষান্তরে আবু সাইদ খুদরির রা. হাদিসের বক্তব্য সুস্পষ্ট।[৫৪]

উপরের আলোচনা দ্বারা আমাদের সামনে রিবায়ে নাসিয়া এবং রিবায়ে ফযল উভয়টার হারাম হওয়া প্রমাণিত হয়। সুতরাং কোনো প্রশ্ন বা সংশয়ের অবকাশ নেই।

চতুর্থ অধ্যায় : বাইয়ে ইনা

(ক) বাইয়ে ইনা'র সংজ্ঞা :
কেউ তার কোনো পণ্য অপরের কাছে বাকিতে বিক্রি করে ক্রেতার হাতে পণ্য তুলে দিল। তারপর সে মূল্য পরিশোধের আগেই তার (ক্রেতার) কাছ থেকে বিক্রেতা ওই একই পণ্য নগদ মূল্যে কিনে নিল তার চেয়ে কম মূল্যে।[৫৫]

যেমন- কেউ তার পণ্য অপর এক ব্যক্তির কাছে এক বছর সময় দিয়ে বাকিতে একশ' টাকা মূল্যে বিক্রি করল। অতপর একই সময়ে বিক্রেতা তার সদ্য বেচা পণ্য ক্রেতার কাছ থেকে নগদ পঞ্চাশ টাকা মূল্যে কিনে নিল আর প্রথম ক্রেতার কাঁধে পুরো একশ টাকার ঋণ রয়ে গেল!

(খ) বাইয়ে ইনা'র নিন্দায় উচ্চারিত কিছু বক্তব্য :
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে ইরশাদ করতে শুনেছি, তিনি বলেন- 'যখন তোমরা পরস্পর বাইয়ে ইনা'র লেনদেন করবে আর জিহাদ ছেড়ে দিয়ে বলদের লেজ ধরে সন্তুষ্ট থাকবে কৃষিকাজ নিয়ে, আল্লাহ তাআলা তখন তোমাদের ওপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দিবেন। আল্লাহ এ লাঞ্ছনা তুলে নিবেন না যতক্ষণ তোমরা তোমাদের দীনের দিকে ফিরে আসবে।[৫৬] হাদিসটি আরও কয়েকভাবে বর্ণিত হয়েছে।[৫৭]

মালেক বিন আনাস, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আহমদ এবং কতিপয় শাফেয়ি প্রমুখ উলামায়ে কিরাম বাইয়ে ইনা'কে অবৈধ বলেছেন।

ইমাম শাওকানি রহ. বলেন, 'ইনা'র লেনদেন যারা করে তারা এর নাম দেয় ক্রয়চুক্তি। অথচ আক্‌দ পুরা হওয়ার আগে এমনটি করা যে সুস্পষ্ট রিবার অন্তর্ভুক্ত সে ব্যাপারে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে একমত। তারপর তারা এ চুক্তির নাম দেয় মোয়ামালা। আর একে রূপ দেয় বিক্রয় চুক্তির। অথচ মোটেও তাদের এ ইচ্ছে নেই। এ হচ্ছে তাদের হিলা-বাহানা আর আল্লাহর সঙ্গে নিষ্ফল প্রতারণা। বাইয়ে ইনা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি সবচে সহজ যে হিলা আবলম্বন করে তা হলো, সে তাকে (উদাহরণ স্বরূপ) এক টাকা কম এক হাজার টাকা কর্জ দেয়। অতপর তার কাছে এক দিরহাম মূল্যের এক টুকরো কাপড় বিক্রি করে পাঁচশ টাকায়।

এ ধরনের চালাকির মূলে কুঠারাঘাত করেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর বিখ্যাত সে হাদিস 'নিশ্চয় প্রত্যেক কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।'[৫৮] কারণ সে চায় এক হাজার টাকা দিয়ে দেড় হাজার টাকা কামাতে। তার কর্জ দেয়ার উদ্দেশ্যই হলো, অতিরিক্ত সুদ লাভ করা যেটাকে সে কাপড়ের মূল্য নাম দিয়ে হাসিল করতে চাইছে। প্রকৃতপক্ষে সে তাকে নগদ এক হাজার টাকা দিচ্ছে বাকিতে দেড় হাজার টাকার বিনিময়ে। আর কর্জ ও ক্রয়ের রূপ দিয়ে সে এ হারাম কাজ বৈধ করতে চাচ্ছে। আর এটা জানা কথা যে, এ ধরনের হিলা-বাহানা এর অবৈধতাকে রুখতে পারে না। সুদকে যেসব অকল্যাণের কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাও দূর করতে পারে না। বরং তা বিভিন্নভাবে এর অপকারিতা বাড়িয়ে দেয়।[৫৯]

তৃতীয় পর্ব
যে সব ক্ষেত্রে কম-বেশি করা বা বাকি দেয়া জায়িয আছে।

এ পর্বে রয়েছে তিনটি অধ্যায়। যথা-
প্রথম অধ্যায় : যে সব ক্ষেত্রে কম-বেশি করা বা বাকি দেয়া জায়িয আছে
দ্বিতীয় অধ্যায় : বাইয়ে সরফ এবং তার বিধান।
তৃতীয় অধ্যায় : সন্দেহ থেকে দূরে থাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করণ।

প্রথম অধ্যায় : যে সব ক্ষেত্রে কম-বেশি করা বা বাকি দেয়া জায়িয আছে

(ক) কম-বেশি করা জায়িয যখন 'ইল্লত' অনুপস্থিত থাকবে :
ইমাম নাববি রহ. বলেন, আলেমগণ একমত যে, রেবা জাতীয় পণ্যকে রেবা জাতীয় পণ্যের বিনিময়ে কমবেশি করে এবং বাকিতে বিক্রি করা বৈধ যদি উভয়ের ইল্লত ভিন্ন হয়। যেমন- গমের বিনিময়ে সোনা বিক্রি এবং যবের বদলে রুপা ইত্যাদি পরিমাপযোগ্য পণ্য বিক্রি। তেমনি জাত ভিন্ন হলে নগদে কমবেশি করে বেচা-কেনা জায়িয এ ব্যাপারেও তাঁরা একমত। যেমন- এক সা' গমের বিনিময়ে দুই সা' যব কেনা ইত্যাদি।[৬০]
(খ) অপরিমাপযোগ্য জিনিসের মাঝে কমবেশি করে বিক্রি জায়িয :
ফিকাহবিদগণ প্রাণীকে প্রাণীর বদলে বাকিতে বিক্রির বৈধতা সম্পর্কে মতবিরোধ করেছেন। অধিকাংশ উলামার মতে, এটা বৈধ। তাদের দলিল আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রা. এর হাদিস। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার উটের পালের পিঠে আমাকে একটি সৈন্যদল পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। আমি লোকদের উটের পিঠে চড়ালাম। এক পর্যায়ে আমার উট শেষ হয়ে গেল। বাকি রয়ে গেল কয়েকজন- আমি তাদের বাহনের ব্যবস্থা করতে পারলাম না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, তুমি আমার পক্ষে কয়েকটি উট কেন সদকার উট দিয়ে আমি তা পরিশোধ করে দেব। যাতে এ দলটি পূর্ণ হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ রা. বলেন, তাঁর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথা মত আমি একেকটি উট কিনতে থাকি দুটি তিনটি করে উটের বিনিময়ে। এমনকি দল পূর্ণ হয়ে গেল। তিনি বলেন, যখন সদকার উট বাটোয়ারা শুরু হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা পরিশোধ করে দিলেন।[৬১]

জাবের রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'একজন দাস এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাতে হিজরতের বাইয়াত করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম টের পান নি যে সে একজন গোলাম। পরে দাসের মুনিব এসে তাকে চাইল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, একে আমার কাছে বিক্রি করে দাও। অতপর তিনি তাকে দুইজন হাবশি গোলামের বিনিময়ে কিনে নেন। পরবর্তীতে তিনি কাউকে বাইয়াত করতেন না যতক্ষণ না জিজ্ঞেস করেন (সে কারো দাস কি না)।[৬২]

এ থেকে বুঝা যায়, দুই গোলামের বিনিময়ে এক গোলাম বিক্রি করা জায়িয আছে। চাই এদের মূল্য একই রকম হোক বা ভিন্ন। এটা নগদ হলে সবাই এর বৈধতার ব্যাপারে একমত। মানুষ ছাড়া অন্যান্য পশুর ক্ষেত্রেও একই বিধান।[৬৩]

কেউ যদি এক গোলাম দুই গোলামের বিনিময়ে কিংবা এক উট দুই উটের বিনিময়ে বাকিতে বিক্রি করে তাহলে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতানুযায়ী তা বৈধ। এটাই ইমাম শাফেয়ি এবং জমহুরের মত।[৬৪]

উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে, অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতানুসারে বাকিতে বা কমবেশি করে প্রাণীর বদলে প্রাণী বিক্রি করা জায়িয। কয়েকজন সাহাবি এবং তাবেয়ির বক্তব্যও প্রমাণ করে এমনটি। ইমাম বুখারি রহ. তদীয় সহি বুখারিতে বলেন-

১-ইবনে উমর রা. একটি সাওয়ারি প্রাণী খরিদ করেছেন নিজের জিম্মায় চারটি উটের দায়িত্ব নেয়ার মাধ্যমে। যা তিনি দিয়ে দিয়েছেন রাবাযা নামক স্থানে।
২-রাফে বিন খাদিজ রা. দুই উটের বিনিময়ে এক উট কেনেন। তাকে একটি উট দেন আর বলেন, অপরটা তোমাকে কাল দেব ইনশাআল্লাহ।
৩-ইবনে আব্বাস রা. বলেন, 'এক উট কখনো দুই উটের চেয়ে উত্তম হয়।'
৪-ইবনে মুসাইয়াব বলেন, বাকিতে এক উটের মোকাবেলায় দুই উট কিংবা এক ছাগলের বিনিময়ে দুই ছাগল বেচায় কোনো সুদ নেই।[৬৫]

দ্বিতীয় অধ্যায় : বাইয়ে সরফ এবং তার বিধান

(ক) মুরাতালা :
আরবি مراطلة শব্দটি رطل থেকে উদ্গত। যা مفاعلة এর মাসদার। পরিভাষায় মুরাতালা বলা হয় ওজনে সোনার বিনিময়ে সোনা কিংবা রুপার বিনিময়ে রুপা বিক্রি করাকে।[৬৬]

ইমাম মালেক রহ. বলেন, 'আমাদের মতে তোলার হিসেবে স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ এবং রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বিক্রি করায় কোনো সমস্যা নেই। যেমন- কেউ নগদ মূল্যে দশ দিনারের বিনিময়ে দশ দিনার কিনল সেটাকে টাকা হিসেবে নয় স্বর্ণ হিসেবে পরিমাপ করে। এতে কোনো অসুবিধা নেই যদিও সংখ্যা কমবেশি হয়। এ ব্যাপারে দিরহামের হুকুমও অভিন্ন।[৬৭]

এর ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ এবং রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় এর সংখ্যা নয় ; ওজন। অতএব কারো কাছে যদি সোনার দশটি টুকরো থাকে এবং সে তা বিক্রি করে পাঁচ টুকরো সোনার বিনিময়ে। আর দশ টুকরো সোনা যদি ওজনে পাঁচ টুকরোর সমান হয় তাহলে তা বৈধ। ইমাম মালেক রহ. মুরাতালা বলে এটাই উদ্দেশ্য নিয়েছেন।

(খ) সরফ :
মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি লেনদেন পদ্ধতি সরফ। এদিকে সময় দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের লেনদেন পদ্ধতি। ইসলাম এ ব্যাপারে একেবারে উদাসীন নয়। তাই সরফ কোনটা বৈধ কোনটা বৈধ নয়- ইসলাম সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছে।

মালেক বিন আউস বিন হাদাসান রহ. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি বললাম, কে আমার সঙ্গে দিরহাম দিয়ে বাইয়ে সরফ করবে ? তালহা বিন উবাইদুল্লাহ বললেন, (তিনি তখন উমর বিন খাত্তাবের রা. কাছে ছিলেন)- আমাদেরকে তোমার স্বর্ণ দেখাও। তারপর আমাদের গোলাম যখন আসবে তোমাকে তোমার রৌপ্য দিয়ে দিব। উমর বিন খাত্তাব রা. বললেন, খোদার দোহায় এমন করো না কখনো। তাকে রৌপ্য দাও নয়তো তার স্বর্ণ তাকে ফেরত দিয়ে দাও। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রুপা সোনার বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ; হ্যা যদি হাতে হাতে তথা নগদ বিক্রি করা হয়। গম গমের বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ; হ্যা, যদি নগদ বিক্রি করা হয়, যব যবের বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ হ্যা যদি নগদ বিক্রি করা হয় এবং খেজুর খেজুরের বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ হ্যা যদি নগদ বিক্রি করা হয়।[৬৮]

ইমাম নাববি রহ. বলেন, 'উলামায়ে কিরাম বলেছেন, এ হাদিসের অর্থ- পণ্য এবং মূল্য হস্তগত হওয়া। সুতরাং এ হাদিস দ্বারা জানা গেল, সুদী পণ্যকে সুদী পণ্যের মোকাবেলায় বেচতে হলে শর্ত হলো, পণ্য এবং মূল্য উভয়টা নগদ হস্তগত হতে হবে- যখন উভয়ের ইল্লত অভিন্ন হবে। চাই উভয়ের জাত এক হোক যেমন- স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ কিংবা জাত ভিন্ন যেমন- রৌপ্যের বিনিময়ে স্বর্ণ সোনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইল্লত এক জাত ভিন্ন- এমন দুই সামগ্রীর লেনদেনের ব্যাপারেই উপরিউক্ত হাদিসে সতর্ক করেছেন।

আর তালহা বিন আব্দুল্লাহ রা. স্বর্ণ মালিকের সঙ্গে সরফ করতে চেয়েছিলেন। অভিপ্রায় ছিল তিনি স্বর্ণ নিবেন আর রৌপ্য দিবেন পরে খাদেম এলে। এমন করেছিলেন তিনি অন্যান্য বিক্রয় চুক্তির মতো এটাকে হালাল মনে করে। তখনো তিনি মাসআলা জানতেন না যে এটা অবৈধ। সেহেতু উমর রা. তাঁর কাছে হাদিসটি পৌঁছে দেন। ফলে তিনি সরফের এ চুক্তি বাতিল করে দেন।[৬৯]

সুফিয়ান বিন উয়ায়না আমর বিন মিনহাল থেকে বর্ণনা করেন, একদা আমার এক ভাগীদার আগামী মৌসুম বা হজ পর্যন্ত সময় দিয়ে বাকিতে রুপা বিক্রি করল। আমার কাছে আগমন করে সে এ কথা বললে আমি তাকে বললাম, এটা অবৈধ কাজ। সে বলল, আমি এটা বাজারে বিক্রি করলাম কেউ তো আমাকে বারণ করল না। এ কথা শুনে আমি বারা বিন আযেবের রা. কাছে গেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় তাশরিফ আনলেন, আমাদের মাঝে তখন এমন বিক্রয় চুক্তির প্রচলন ছিল। তিনি আমাদের বললেন, 'যেটা নগদ হবে সেটায় সমস্যা নেই আর যা বাকিতে হবে সেটা সুদ।' তুমি যায়েদ বিন আরকাম রা. এর কাছে যাও। কারণ তিনি আমার চেয়ে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। (সুতরাং তিনি এ ব্যাপারে ভালো জানবেন।) আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি একই উত্তর দিলেন।[৭০]

ইমাম বুখারি রহ. বলেন, (এ অধ্যায় নগদ মূল্যে সোনা দিয়ে রুপা কেনা সম্পর্কে) তারপর তিনি আবু বাকরা রা. এর হাদিস উল্লেখ করেছেন। হাদিসে বলা হয়েছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুপার বিনিময়ে রুপা এবং সোনার বিনিময়ে সোনা বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। হ্যা যদি সমান সমান হয় তাহলে বৈধ। এবং তিনি আমাদেরকে যেভাবে ইচ্ছে সোনার বিনিময়ে রুপা এবং রুপার বিনিময়ে সোনা কেনার অনুমতি দিয়েছেন।[৭১]

ইমাম বুখারি বারা বিন আযেব এবং যায়েদ বিন আরকাম থেকে বর্ণনা করেন, 'নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাকিতে স্বর্ণ দিয়ে রৌপ্য কিনতে নিষেধ করেছেন।[৭২]

উপরের হাদিসগুলো দ্বারা আমরা বুঝলাম-
১. সোনার বিনিময়ে সোনা বাইয়ে সরফ হিসেবে বিক্রি করা বৈধ। শর্ত হলো, সমান সমান এবং নগদ নগদ হতে হবে।
২. সোনার বিনিময়ে রুপা এবং রুপার বিনিময়ে সোনা বেচা জায়িয। শর্ত হলো, তা হতে হবে নগদ। আর কমবেশি করা, যেমন ওজনে সোনা বেশি হওয়া বা রুপা বেশি হওয়া- তো এতে কোনো সমস্যা নেই। শর্ত শুধু এই যে, সেটা হতে হবে সরফ চলাকালেই একেবারে হাতে হাতে।
৩. সোনার বিনিময়ে সোনা বা সোনার বিনিময়ে রুপা কেনা বা বেচা বাকিতে কোনোটাই বৈধ নয়। সুতরাং কেউ যদি সোনার বিনিময়ে সোনা খরিদ করতে চায় আর একজন সোনা হস্তান্তর করে অন্যজন বাকি রাখে তাহলে তা কিছুতেই বৈধ হবে না। কারণ এ চুক্তিতে পণ্য এবং মূল্য হস্তান্তর করার শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে।

তৃতীয় অধ্যায় : সন্দেহ থেকে দূরে থাকতে উৎসাহ দান

মুসলমান মাত্রেই চায় শরিয়তের বিষয়গুলো দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে। তাই সে ওয়াজিবগুলো পালন করে। হারাম এবং মাকরুহ বিষয়গুলো বর্জন করে। সচেষ্ট থাকে মুস্তাহাব কাজগুলো বেশি বেশি করতে। মুবাহ কাজগুলোর মধ্যে নিজ অবস্থা ও প্রয়োজন অনুপাতে কোনোটা করে আবার কোনোটা ছাড়ে। আর দূরে থাকে অস্পষ্ট এবং শংকাপূর্ণ কাজ থেকে। কারণ সে জানে অস্পষ্ট কাজগুলোই সুস্পষ্ট হারাম কাজে লিপ্ত করে।

নুমান বিন বাশির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে বলতে শুনেছি (এ কথা বলে তিনি আঙ্গুল দিয়ে নিজ কানের দিকে ইঙ্গিত করেন; অর্থাৎ নিজ কানে শুনেছি।)- 'নিশ্চয় হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট; এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে অস্পষ্ট বিষয়াবলি- যা অধিকাংশ লোকই জানে না। সুতরাং যে অস্পষ্ট বিষয়াবলি থেকে দূরে থাকবে তা তার সম্মান ও দীনদারি উভয়ের জন্য কল্যাণকর সাব্যস্ত হবে। পক্ষান্তরে যে এতে পতিত হবে সে হারামে লিপ্ত হবে। যেমন- রাখাল সংরক্ষিত এলাকা থেকে সভয়ে দূরে থাকে যাতে সে এতে ঢুকে না পড়ে। মনে রেখ প্রত্যেক রাজারই কিছু সংরক্ষিত স্থান থাকে আরও মনে রেখ আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা (যার সীমানা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ) হলো, তাঁর হারাম ঘোষিত বিষয়গুলি। তোমরা মনে রেখ, নিশ্চয় (মানুষের) শরীরে একটি মাংসপিণ্ড আছে। সেটা যদি সুস্থ থাকে তাহলে সারা দেহ সুস্থ আর সেটা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। মনে রেখ সেটা হলো কলব বা আত্মা।'[৭৩]

ইমাম নাববি রহ. বলেন, 'এ হাদিসের সীমাহীন গুরুত্ব ও অপরিসীম তাৎপর্যের ব্যাপারে আলেমগণ একমত। এটি সে হাদিসসমূহের অন্যতম যেগুলোর ওপর শরিয়তের ভিত্তি। একদল আলেম বলেছেন, হাদিসটি ইসলামের এক তৃতীয়াংশ। অপর দুই তৃতীয়াংশের একটি 'নিশ্চয় কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল'[৭৪] এবং মানুষের ইসলামের সৌন্দর্য হলো, সে অনর্থক কাজ পরিহার করবে শীর্ষক হাদিস।[৭৫]

ইমাম আবু দাউদ রহ. বলেন, পুরো ইসলাম চারটি হাদিসকে ঘিরে আবর্তিত। উল্লেখিত তিনটি এবং 'তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে অপর ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে নিজের জন্য যা করে'[৭৬] শীর্ষক হাদিস। কেউ বলেছেন, চতুর্থ হাদিসটি হলো, তুমি দুনিয়ার ব্যাপারে বিরাগ হও আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন আর মানুষের হাতে যা রয়েছে তা থেকে বিরাগ হও লোকে তোমাকে ভালোবাসবে।[৭৭]

উলামায়ে কিরাম বলেন, (নুমান বিন বাশির রা. বর্ণিত) হাদিসটি অবর্ণনীয় গুরুত্বের দাবিদার এ জন্য যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতে বস্ত্র, আহার্য ও পানীয়সহ মৌলিক সবকিছু সংশোধন করার কথা বলেছেন। তাগিদ দিয়েছেন অস্পষ্ট বিষয় থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকার প্রতি। কারণ তা ধার্মিকতা ও সম্মান রক্ষায় সহায়ক। সতর্ক করেছেন সন্দেহে পতিত হওয়া থেকে। উপরন্তু বিষয়টাকে স্পষ্ট করেছেন সংরক্ষিত স্থানের চমৎকার এক দৃষ্টান্ত পেশ করে। অবশেষে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটিও উল্লেখ করেছেন। আর সেটা হলো, আত্মার প্রতি লক্ষ্য রাখা। তাঁর কথা, আত্মা শুদ্ধ থাকলে সারা দেহ ঠিক এর ব্যতিক্রম হলে পুরো দেহে সমস্যা দেখা দিবে।

তবে পয়গম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উক্তি 'হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট' এর অর্থ, - বিষয় মোট তিন প্রকার।
(ক) সুস্পষ্ট হালাল- যা বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না; যে কেউ বুঝতে পারে। যেমন- রুটি, মধু ইত্যাদি।
(খ) সুস্পষ্ট হারাম- যা বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না; যে কেউ বুঝতে পারে। যেমন- মদ, শূকর ইত্যাদি।
(গ) মুশ্‌তাবিহাত অর্থাৎ যার হালাল হওয়া বা হারাম হওয়া কোনোটাই স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ লোকই এর হুকুম বুঝতে পারে না। শুধু উলামায়ে কিরাম কিয়াস, নস বা অন্য কোনোভাবে তার হুকুম জানেন।[৭৮]

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর প্রিয় কাজগুলো করার এবং অপ্রিয় কাজগুলো থেকে বিরত থাকার তাওফিক দেন। আমিন।

চতুর্থ পর্ব
সমকালীন রিবা সংক্রান্ত কতিপয় মাসআলার ব্যাপারে ফতোয়া

প্রথম মাসআলা : শরয়ি দৃষ্টিকোণে কাগুজে মুদ্রা এবং তার বিধান

এ মাসআলা সম্পর্কে সৌদি মুফতি বোর্ডের লিখিত ফতোয়া প্রকাশ করা হয়েছে। নিম্নে হুবহু তার অনুবাদ তুলে ধরা হলো-
হামদ ও সালাতের পর, সৌদি মুফতি বোর্ড বরাবর উপস্থাপিত 'শরয়ি দৃষ্টিকোণে কাগজের টাকা ও তার বিধান' শীর্ষক গবেষণাকর্মটি বোর্ডের সদস্যবৃন্দ যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করেছেন। তারা পরস্পর আলোচনা-পর্যালোচনা এবং বিচার-বিশ্লেষণ করে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোয় সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।

প্রথমত. যেহেতু সোনা-রুপাই টাকার মূল এবং আলেমদের বিশুদ্ধ মতানুসারে সোনা-রুপায় তাদের মূল্যমানই সুদের ইল্লত আর ফকিহদের মতানুসারে উৎস এক হওয়া সত্ত্বেও সোনা-রুপাতেই মূল্যমানতা সীমাবদ্ধ নয় তাই। এবং যেহেতু টাকাই বর্তমানে মূল্য হিসেবে প্রচলন পেয়েছে, লেনদেনের বেলায় স্থান দখল করেছে সোনা-রুপার, এমনকি এ দিয়ে লেনদেন চলে, মানুষ এটা অর্জন ও সঞ্চয় করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে অথচ নিছক কাগজ হিসেবে তার কোনো মূল্য নেই; মূল্য তার অতিরিক্ত কারণে সেটা হলো, এর দ্বারা আস্থা অর্জন করা এবং লেনদেনের সময় বিনিময় মাধ্যম স্থির হওয়া আর এটাই মূল্যযোগ্য হওয়ার উদ্দেশ্য- এতসব কারণে মুফতি বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, কাগজের টাকা একধরনের স্বতন্ত্র মুদ্রা যার বিধান সোনা-রুপার বিধানের অনুরূপ। সুতরাং এতে জাকাত ওয়াজিব হবে এবং এর ওপর সোনা-রুপার মতো সুদের উভয় প্রকার তথা ফযল ও নাসিয়া খাটবে। এককথায় কাগজের টাকা শরিয়তের সকল লেনদেনের ক্ষেত্রে সোনা-রুপার অনুরূপ হবে।
দ্বিতীয়ত. সোনা-রুপা ও অন্যান্য মুদ্রার মতো কাগজকেও স্বতন্ত্র মুদ্রা হিসেবে ধরা হবে। তেমনি কাগজের নোটকেও বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হবে। এটা হবে দেশ ও প্রকাশ-প্রচলন স্থানের ভিন্নতা বিচার করে। অর্থাৎ সৌদি টাকা এক শ্রেণী আর মার্কিনি টাকা আরেক শ্রেণী। এভাবে প্রত্যেক দেশের টাকা মুদ্রার একেক স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসেবে গণ্য হবে। আর সে অনুযায়ী সোনা-রুপা ও অন্যান্য মূল্যের মতো কাগজের মুদ্রা বা নোটের ওপরও সুদের বিধান খাটানো হবে।

আর এসবই নিম্নোক্ত বিষয়গুলো দাবি করে :

(ক) কেবল নগদ ছাড়া বাকিতে কোনোভাবে কাগজের নোট একটার বদলে একটা কিংবা মুদ্রার অন্য কোনো প্রকার যেমন- সোনা,রুপা ইত্যাদির মোকাবেলায় বিক্রি করা বৈধ নয়। অতএব উদারণত, সৌদি রিয়াল অন্য কোনো দেশের কাগজের টাকার মোকাবেলায় কমবেশি করে হস্তগত না করে বাকিতে বিক্রি করা বৈধ নয়।
(খ) একই (দেশের) ধরনের কাগজের মুদ্রার একটার মোকাবেলায় অন্যটা কমবেশি করে বিক্রি করা বৈধ নয়; চাই তা নগদে হোক বা বাকিতে। সুতরাং কাগজের সৌদি দশ রিয়াল কাগুজের এগারো রিয়ালের বিনিময়ে বিক্রি করা বাকিতে বা নগদে কোনোটাই বৈধ নয়।
(গ) দুই ধরনের দুই কাগজের মুদ্রা একটার বিনিময়ে আরেকটা বিক্রি করা বৈধ। যদি তা হয় হাতে হাতে। সুতরাং পাকিস্তানি রুপি দিয়ে সৌদি রিয়াল ক্রয় করা জায়িয। চাই তা সোনার হোক বা রুপার, কম হোক বা বেশি। তেমনি এক মার্কিন ডলার সৌদি তিন রিয়াল কিংবা তার কম বা বেশি দিয়ে বিক্রি করা এবং সৌদি রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে সৌদি কাগুজে মুদ্রা কমবেশি করে বিক্রি করা জায়িয। যদি তা হয় নগদে। কারণ এটাকে এক জাতীয় মুদ্রার বিনিময়ে আরেক জাতীয় মুদ্রা বিক্রি হিসেবে গণ্য করা হবে। আর বাস্তবতা এবং মূল্য ভিন্ন হলে শুধু নাম এক হওয়ায় কোনো সমস্যা নেই।

তৃতীয়ত. সোনা-রুপার মতো কাগুজে মুদ্রার ওপরও জাকাত ফরজ হবে যখন স্বর্ণ বা রৌপ্য কোনোটার নেসাব পরিমাণ টাকা হবে। অথবা নেসাব পূর্ণ হবে অন্য কোনো মূল্য বা ব্যবসায়িক পণ্যের সঙ্গে মিলিয়ে।
চতুর্থত. কাগজের মুদ্রাকে বাইয়ে সলম এবং অংশীদারি কারবারগুলোতে মূলধন বানানো যাবে।[৭৯]

দ্বিতীয় মাসআলা : তৃতীয় হিলার বিধান

প্রশ্ন: আমার কয়েক বস্তা চাল আছে সেটাকে আমরা গুদাম হিসেবে ধরি। আমার কাছে লোক এসে বাজার মূল্যে তা কিনল। তারপর সে আবার অন্য একজনের কাছে বাকিতে বিক্রি করল। চাল যখন ঋণগ্রহীতার হাতে পৌঁছল আমি তার কাছে গিয়ে আমার থেকে কেনা মূল্যের চেয়ে এক রিয়াল কমে কিনলাম। এবার আমার হাতে চাল আসার পর লোক এলো এবং আমার কাছ থেকে কিনল। এভাবে পণ্য একই স্থানে থাকল কিন্তু তা একেরপর এক বিক্রি হতে থাকল। এমন করলে কি গুনাহ হবে? জানিয়ে কৃতার্থ করবেন।
উত্তর: এটি মূলত সুদের ওপর হিলা। এমন রিবা যার মধ্যে নাসিয়া এবং ফযল উভয়ই বিদ্যমান। এটা এভাবে যে ঋণদাতা এর মাধ্যমে উদাহরণ স্বরূপ দশ টাকা দিয়ে বারো টাকা উপার্জন করতে চাচ্ছে।

তৃতীয় মাসআলা : পণ্য সস্থানে রেখে বাকিতে ক্রয়-বিক্রয়

প্রশ্ন: পণ্য সস্থানে রেখে বাকিতে তার কেনা-বেচা অব্যাহত রাখার বিধান কী? বর্তমানকালে এ ধরনের বাকি লেনদেন ব্যাপক প্রচলন পেয়েছে।
উত্তর: মুমিনের জন্য কোনো পণ্য নগদে বা বাকিতে বিক্রি করা ততক্ষণ বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে এর মালিক হয় এবং পণ্য তার হাতে আসে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাকিম বিন হাযাম রা. কে বলেছেন- 'যা তোমার কাছে নেই তা বিক্রি করতে পার না।'[৮০] অন্যত্র বলেছেন- 'যা তোমার হাতে নেই তা তুমি ঋণ হিসেবে কাউকে দিতে পারে না কিংবা বেচতেও পার না কারো কাছে।'[৮১] ঠিক তেমনি যে জিনিস কেনা হলো তাও সে বিক্রি করতে পারবে না, যতক্ষণ জিনিসটি তার হস্তগত হয়। কেননা ইমাম আহমদ ও আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন যে, যায়েদ বিন সাবেত রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সদ্য কেনা পণ্য নিজ বাহনে ব্যক্তিগত হেফাজতে না নেয়া পর্যন্ত বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন।[৮২]

তেমনি ইমাম বুখারি তাঁর সহিহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. বলেন, আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর যুগে মানুষকে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করতে দেখেছি। দেখেছি তাদের শাস্তি দেয়া হতো যদি পণ্য নিজ বাহনে (সংরক্ষণে) না নিয়ে বিক্রি করত।[৮৩] এ দু'টি ছাড়াও এ ব্যাপারে আরও অনেক হাদিস রয়েছে।[৮৪]

চতুর্থ মাসআলা : নোট বদল

প্রশ্ন: আমি এক নির্দিষ্ট ব্যক্তি থেকে চল্লিশ হাজার সৌদি রিয়ালের বিনিময়ে দশ হাজার আমেরিকান ডলার কিনেছি। এ চল্লিশ হাজার রিয়াল শোধ করব মাসিক কিস্তিতে। প্রতি কিস্তি এক হাজার রিয়াল। এখন আমি সে ডলারগুলো বাজারে নিয়ে সাইত্রিশ হাজার পাঁচশ রিয়াল দিয়ে বেচতে চাচ্ছি। এটা কি আমার জন্য বৈধ হবে? উল্লেখ্য যে, আমার এ টাকার খুব প্রয়োজন।
উত্তর: আপনার প্রশ্নের উত্তর, না। এমনটি করা হারাম। কেননা নোট বদলের সময় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের বিনিময় হস্তগত না করা পর্যন্ত আলাদা হওয়া হারাম। আর প্রশ্নে বর্ণিত সুরতে দ্বিতীয় বিনিময় তথা ডলারের মূল্য পরিশোধ করা হয়নি। সুতরাং এ সুরত বাতিল ও প্রত্যাহারযোগ্য। এখন যা হবার তা যেহেতু হয়েই গেছে তাই যে ডলার নিয়েছে তার জন্য অত্যাবশ্যক হলো, ডলার ফেরত দেয়া এবং প্রথম চুক্তির ওপর নির্ভর না করা। কারণ তা অবশ্য বাতিলযোগ্য। আর এটা প্রমাণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- প্রত্যেক শর্ত যা আল্লাহর কিতাবে নেই তা অবশ্য প্রত্যাহারযোগ্য যদিও তা একশ বার করা হোক না কেন। আল্লাহর ফয়সালাই সঠিক এবং আল্লাহর শর্তই অধিক মজবুত।[৮৫]

পঞ্চম মাসআলা : ব্যবহৃত স্বর্ণ দিয়ে (অব্যবহৃত) নতুন স্বর্ণ ক্রয়

প্রশ্ন: এক লোক অলঙ্কারাদি ক্রয়-বিক্রয় করে। একজন তার কাছে এলো কিছু ব্যবহৃত স্বর্ণ নিয়ে। সে ওই স্বর্ণ তার থেকে কিনে নিল। মূল্য নির্ধারণ করল রিয়াল দিয়ে। তারপর সে সময় ও সে স্থানে মূল্য পরিশোধের আগেই পুরাতন স্বর্ণ বিক্রেতার কাছে নতুন স্বর্ণ বিক্রি করল। এর দামও নির্ধারণ করল রিয়াল দিয়ে। এরপর যতটুকু বাকি থাকল তা পরিশোধ করবে টাকা দিয়ে। জানতে চাই- এটা কি জায়িয নাকি আগে প্রথম ক্রয়-চুক্তির টাকা বিক্রেতার কাছে পুরোটা দিয়ে দিতে হবে তারপর বিক্রেতা যে নতুন স্বর্ণ কিনেছে তার মূল্য ওই টাকা বা অন্য কোনো টাকা থেকে পরিশোধ করতে হবে?
উত্তর: এসব ক্ষেত্রে ওয়াজিব হলো প্রথমে ব্যবহৃত স্বর্ণ হস্তান্তর করা। তারপর বিক্রেতা যখন মূল্য হাতে পাবে তখন তার ইচ্ছা। চাইলে যার কাছে পুরাতন স্বর্ণ বিক্রি করেছে তার কাছ থেকে অথবা চাইলে অন্যের কাছ থেকে নতুন স্বর্ণ কিনবে। এখন সে যদি তার কাছ থেকেই নতুন স্বর্ণ কেনে তাহলে তার জন্য উভয় সুযোগ রয়েছে। চাইলে নতুন স্বর্ণের মূল্য হিসেবে তার টাকাই তাকে ফেরত দিবে অথবা অন্য টাকা দিবে। এমন করার উদ্দেশ্য যাতে মুসলমান সুদী দ্রব্যের ভালোর বদলে কমবেশি করে মন্দটা বিক্রি করার মতো হারাম কাজে লিপ্ত না হয়।

ইমাম বুখারি রহ. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে খায়বরের গভর্নর বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। একবার তিনি তাঁর দরবারে জানিব নামক উৎকৃষ্ট জাতের খেজুর নিয়ে আসেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করেন খায়বরের সব খেজুরই এমন কি-না। তিনি উত্তর দেন, না। আমরা এ খেজুরের এক সা' কিনি সাধারণ খেজুর দুই সা' দিয়ে আর এর দুই সা' নেই সাধারণ খেজুরের তিন সা' দিয়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এমন করো না; বরং সাধারণ (জানিব) খেজুর কেনো দিরহাম দিয়ে তারপর সে দিরহামের বিনিময়ে জানিব কেনো।[৮৬]

কারণ এ ধরনের ক্রয়-চুক্তিতে লেন-দেন ক্লিয়ার করণ যদিও একই সময়ে একই স্থানে হয় কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত 'সোনার বদলে কমবেশি করে সোনা বিক্রি'রই রূপ পরিগ্রহ করে। যা সুস্পষ্ট হারাম।

ইমাম মুসলিম রহ. উবাদা বিন সাবেত রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- সোনার বদলে সোনা, রুপার বদলে রুপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর এবং লবণের বদলে লবণ বিক্রি করো নগদ নগদ এবং সমান সমান। তবে যখন এসব জিনিসের প্রকার পরিবর্তন করা হবে তো যেভাবে ইচ্ছে বিক্রি করো অবশ্য যখন সেটা হতে হবে নগদ নগদ। আবু সাইদ খুদরির এক রেওয়াতে আছে, যে বেশি দিবে অথবা বেশি নিবে সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। দাতা -গ্রহীতা এক্ষেত্রে সমান অপরাধী।[৮৭]

প্রশ্ন: আমি স্বর্ণ-বিক্রেতার কাছে কিছু পুরাতন স্বর্ণ নিয়ে গেলাম। স্বর্ণ-বিক্রেতা সেসব ওজন করে বললেন, এর দাম হবে ১৫০০ রিয়াল। তার কাছে ১৫০০ রিয়াল মূল্যে স্বর্ণগুলো বিক্রি করে আমি একই ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু নুতন স্বর্ণ কিনলাম- যার দাম ১৮০০ রিয়াল। এখন জানতে চাচ্ছি, আমার জন্য কি জায়িয হবে যে আমি তাকে শুধু ৩০০ রিয়াল দিয়ে দিব? নাকি প্রথমে ১৫০০ রিয়াল হস্তগত করব তারপর একসাথে ১৮০০ রিয়াল তাকে দিব?
উত্তর: নগদ মূল্যে হাতে হাতে সমান দামে ছাড়া স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করা জায়িয নেই যদিও ভালো-মন্দ হিসেবে তার প্রকার বদলানো হোক না কেন- এ কথা হাদিসে বারবার বলা হয়েছে দ্ব্যর্থহীনভাবে। বৈধ উপায় হলো- যে স্বর্ণ দিয়ে স্বর্ণ কিনতে ইচ্ছুক সে প্রথমে তার কাছে যে স্বর্ণ আছে তা রুপা বা কাগজের মুদ্রা দিয়ে সে বিক্রি করবে তারপর সে মুদ্রা বা রুপা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণ কিনবে। তবে যদি সোনা-রুপা বিক্রি করা হয় কাগজের মুদ্রা বৈ অন্য কিছু দিয়ে যেমন- পরিবহন সামগ্রী কিংবা চিনি ইত্যাদির বিনিময়ে তবে চুক্তির উভয় মাধ্যম তথা পণ্য ও মূল্য হস্তগত করার আগেই ক্রেতা-বিক্রেতা মজলিস ত্যাগ করায় কোনো সমস্যা নেই। কারণ স্বর্ণ, রৌপ্য ও কাগজের মুদ্রা এবং এসব এবং এ ধরনের বস্তুর মাঝে রিবা বা সুদের বিধান প্রযোজ্য নয়। উল্লেখ্য যে, বিক্রি চুক্তি যখন বাকিতে হবে তখন পরিশোধের তারিখ নির্ধারণ করা জরুরি। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- 'হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরস্পর ঋণের লেনদেন করবে, তখন তা লিখে রাখবে।'[৮৮]

ষষ্ঠ মাসআলা : বাকিতে স্বর্ণ বা রৌপ্য বিক্রি

প্রশ্ন: এক ব্যক্তি আমার কাছ থেকে একটি সোনার গহনা নিয়েছে। অলঙ্কারটির দাম এক হাজার রিয়াল। আমি তাকে বললাম, এটা নগদ ছাড়া বিক্রি করা বৈধ হবে না। সে বলল, তুমি আমাকে এক হাজার রিয়াল কর্জ দাও। আমি তাকে কর্জ দিলাম আর সে ওই রিয়ালই আমাকে গহনার মূল্য হিসেবে দিল। এমন করা বৈধ হবে কি?
উত্তর: না বৈধ হবে না। কারণ এটিও সুকৌশলে সুদী কারবার। উপরন্তু এতে দুই আকদ একত্রিত হচ্ছে। একটি বাকির আকদ অপরটি বিক্রির আকদ। আর এমনটিও নিষিদ্ধ।[৮৯]
প্রশ্ন: আমার কাছে এক ব্যক্তি স্বর্ণালঙ্কার কিনতে আসল। তার পছন্দকৃত অলঙ্কারটি ওজন করে দেখা গেল তার কাছে যত টাকা আছে তা এর মূল্য হিসেবে যথেষ্ট নয়। এখন জানা কথা যে, তার কাছে স্বর্ণালঙ্কারটি বিক্রি করা এবং সেটা তার হাতে তুলে দেয়া বৈধ হবে না। কিন্তু সে যদি ধরুন প্রভাতে আমার কাছে এসে থাকে এবং বলে, অলঙ্কারটি আপনার কাছেই রাখুন আমি আসরের সময় এসে পুরা টাকা নিয়ে উপস্থিত হয়ে তবেই আপনার কাছ থেকে নিব।

জিজ্ঞাস্য হলো, এমতাবস্থায় আমার জন্য কি বিকালে তার টাকা পাবার এমন নিশ্চয়তার ওপর ভিত্তি করে এ অলঙ্কার তার ব্যাগে দিয়ে দেয়া বৈধ হবে? নাকি আমার কর্তব্য তার এ চুক্তিকে নিরর্থক মনে করা। তারপর সে যদি উপস্থিত হয় তখন সে অন্যান্য ক্রেতার মতো তার সঙ্গে নতুন ক্রয় চুক্তি কার্যকর করা? নয়তো আমাদের মাঝে কোনো চুক্তি নেই বলে মনে করব।
উত্তর: তার কথা মতো এ বিক্রয় চুক্তি কার্যকর করার সুযোগ নেই। যাবৎ না সে সম্পূর্ণ মূল্য নিয়ে উপস্থিত হয়। এভাবেই আপরি রিবায়ে নাসিয়া বা বাকি বিক্রির সুদ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। সুতরাং আপনি স্বর্ণালঙ্কারটি নিজের কাছেই রাখবেন। অতপর সে যখন সম্পূর্ণ মূল্য নিয়ে আপনার কাছে আসবে তখন আপনার উভয়ে নতুন এক ক্রয় চুক্তি করবেন যে চুক্তিতে উভয় মাধ্যম উপস্থিত বৈঠকেই সম্পন্ন হবে।[৯০]

সপ্তম মাসআলা : ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে অংশগ্রহণ

প্রশ্ন: আমি একজন কুয়েতি নাগরিক। আমাদের দেশে বিভিন্ন কৃষি ও বাণিজ্যিক কোম্পানি রয়েছে। রয়েছে ব্যাংক, বীমা ও পেট্রোল কোম্পানি। এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য এসব কোম্পানির পার্টনার হওয়ার অনুমতি রয়েছে। জানতে ইচ্ছুক এসব কোম্পানিতে শেয়ার হোল্ডার হওয়া যাবে কি-না।

উত্তর: সবার জন্য এসব কোম্পানিতে অংশগ্রহণ করা বৈধ যদি সে কোম্পানি সুদী কারবার না করে। যদি সুদী লেনদেন করে তাহলে জায়িয হবে না। কারণ কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার মাধ্যমে সুদের হারাম হওয়া প্রমাণিত। তেমনিভাবে মানুষের জন্য বাণিজ্যিক বীমা কোম্পানিতে অংশগ্রহণ করাও বৈধ নয়। কারণ বীমা চুক্তিগুলো প্রতারণা, অজ্ঞতা এবং সুদে পরিপূর্ণ। আর যেসব চুক্তি প্রতারণা, অজ্ঞতা এবং সুদে ভরা ইসলামের দৃষ্টিতে তার সবই হারাম।[৯১]

অষ্টম মাসআলা : সুদী ব্যাংকে লেনদেন

এ ব্যাপারে ইসলামি ফিকাহ বোর্ডের সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়েছে নিম্নে যা হুবহু তুলে দেয়া হলো- ইসলামি ফিকাহ বোর্ড পবিত্র মক্কাস্থ রাবেতা আলমে ইসলামি'র বিল্ডিংয়ে সাত দিনব্যাপী (১২-২৯ রজব ১৪০৬ হিঃ) অনুষ্ঠিত তার নবম বৈঠকে ভেবে দেখেছে যে, সুদী ব্যাংক ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে এসব ব্যাংকে মানুষের লেনদেন। অথচ তাদের কাছে এসব ব্যাংকের বিকল্প নেই বললেই চলে।

বৈঠকে এই ভয়ঙ্কর সমস্যা নিয়ে সম্মানিত সদস্যবৃন্দের সারগর্ভ আলোচনা যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে শোনা হয়। তাদের বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, আধুনিক অর্থনীতির গবেষণা এ কথা সপ্রমাণ করেছে যে, সুদই বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি এবং শান্তি-সমৃদ্ধির পথে সবচে' বড় হুমকি। বিশ্বের অনেক সমস্যার আড়ালেই রয়েছে এর প্রত্যক্ষ ভূমিকা। চৌদ্দশ বছর আগেই ইসলামে হারাম ঘোষিত এই বিষাক্ত জীবাণু সমাজ থেকে নির্মূল করা ছাড়া বিশ্বশান্তি অধরাই থেকে যাবে চিরদিন। আর সুদ নির্মূলে সবচে' কার্যকর পদক্ষেপ হলো, সুদ ও শরিয়ত অননুমোদিত লেনদেন মুক্ত ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। নিম্নে বৈঠকের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হলো।

প্রথমত. প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত সুদী লেনদেন সর্বোতভাবে পরিহার করা। এবং সুদী কারবারে যে কোনো রকম সহযোগিতা থেকে বিরত থাকা।
দ্বিতীয়ত. সুদী ব্যাংকগুলোর উত্তম বিকল্প হিসেবে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি মুসলিম দেশ এবং বিশ্বের সকল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এলাকায় ইসলামি ব্যাংকের প্রসার ঘটাতে হবে। এভাবে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি অর্থনীতির বাস্তব রূপায়নে এসব ব্যাংক এক শক্তিশালী নেটওয়ার্কে পরিণত হবে।
তৃতীয়ত. প্রতিটি মুসলমানের জন্য দেশে-বিদেশে যেখানেই ইসলামি ব্যাংক বিদ্যমান সেখানে সুদী ব্যাংকে লেনদেন করা হারাম। কারণ ইসলামি ব্যাংকের মতো বিকল্পের বর্তমানে তার জন্য সুদী ব্যাংকে কারবার করার কোনো অজুহাত বাকি থাকে না। তার ওপর ওয়াজিব অপবিত্র পথ বর্জন করে পবিত্র পথে আসা এবং হারামের স্থলে হালাল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা।
চতুর্থত. এ বৈঠক মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান ও সুদী ব্যাংকসমূহের কর্ণধারদের প্রতি সুদের মতো পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে।
পঞ্চমত. সুদের লাভের পথে আহরিত সকল সম্পদই শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম। কোনো মুসলিমের (আমানতকারী) জন্যই তা নিজের বা পরিবারস্থ লোকদের প্রতি এ টাকা ব্যয় করা বৈধ নয়। বরং উটিৎ হলো, এ টাকা সাধারণ জনকল্যাণ মূলক কাজে যেমন- মাদরাসা, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণে ব্যয় করা। তবে এ টাকা খরচ করার সময় দান-সদকার নিয়ত করা যাবে না। বরং নাপাকি থেকে পবিত্র হওয়ার নিয়ত করতে হবে।

আবার কোনো অবস্থাতেই সুদী ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত লভ্যাংশ বিদেশি ব্যাংকগুলোর জন্য ফেলে রাখা যাবে না। এতে গুনাহ বা অপরাধ বাড়বে বৈ কমবে না। কারণ বিদেশি ব্যাংকগুলো এ টাকা খৃস্টান মিশনারি বা ইহুদি প্রতিষ্ঠনগুলোয় ব্যয় করে। এবং শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের এসব টাকা মুসলমানদেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং তাদের সন্তানদের ঈমান হরণের পেছনে ব্যয় হয়।

নবম মাসআলা : সুদী ব্যাংকে লেনদেন বা চাকুরি

নিচের প্রশ্নগুলোর ইসলামি জবাব প্রত্যাশা করছি।
১. যে ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা রেখেছে বছরান্তে সে কি এর লভ্যাংশ গ্রহণ করতে পারবে ?
২. অতিরিক্ত লাভ দিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদের ওপর ঋণগ্রহীতার লভ্যাংশ ভোগ করে না ?
৩. যে ওইসব ব্যাংকে টাকা আমানত রাখে কিন্তু লভ্যাংশ ভোগ করে না ?
৪. ওই সব ব্যাংকে চাকুরীরত কর্মকর্তা চাই সে পরিচালক বা অন্য কেউ ?
৫. ওই ভূ-স্বামী যে এসব ব্যাংকে তার ভূমি লিজ দেয় ?

উত্তর: লাভের ওপর ব্যাংককে লাভের ওপর ঋণ বা আমানত দেয়া কোনোটাই জায়িয নেই। কারণ এ দুটোই সুস্পষ্ট সুদ। ব্যাংক ছাড়া অন্য কোথাও লাভের ওপর অর্থ আমানত রাখা জায়িয নেই। এভাবে লাভের ওপর কাউকে কর্জ দেয়াও জায়িয নেই। কারণ এর সবই উলামায়ে কেরামের সর্ব সম্মতিক্রমে হারাম। ইরশাদ হয়েছে-'আল্লাহ বেচাকেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।[৯২]

আরও ইরশাদ হয়েছে- আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদাকাকে বাড়িয়ে দেন।[৯৩] অন্যত্র ইরশাদ করেন- 'হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলম করবে না এবং তোমাদের যুলম করা হবে না।'[৯৪] এসবের পর আল্লাহ তাআলা বলেন, আর যদি সে অসচ্ছল হয়, তাহলে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত তার অবকাশ রয়েছে।[৯৫] এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাকে সতর্ক করে বলছেন, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে ঋণের বিনিময়ে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা বৈধ নয়। বরং কর্তব্য হলো বেচারাকে তার সুবিধামত ঋণ পরিশোধের অবকাশ দেয়া। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার ওপর বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহ যাতে সে জুলুম ও নিপীড়ন থেকে বাচতে পারে।

তবে লভ্যাংশ ভোগ না করে শুধু আমানত রাখায় কোনো অসুবিধা নেই যতক্ষণ সুদী ব্যাংকের বিকল্প না পাওয়া যায়। আর সুদী ব্যাংকে চাকুরি করা চাই পরিচালক হিসেবে হোক আর হিসাব রক্ষক, রেজিস্ট্রার বা অন্য যে পদেই হোক বৈধ নয়। কারণ ইরশাদ হয়েছে- সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।[৯৬]

দশম মাসআলা : সুদী ব্যাংকে বীমা করা

প্রশ্ন: যার কাছে টাকা আছে এবং সে তা কোনো ব্যাংকে জমা রাখে আমানত হিসেবে যাতে সে অর্থ সুরক্ষিত থাকে আবার বছরান্তে তার লাভও পাওয়া যায়। এটা কি বৈধ?

উত্তর: সুদী ব্যাংকে বীমা করা জায়িয নেই যদিও তাতে লভ্যাংশ ভোগ না করে। কারণ এর দ্বারা পাপ এবং অন্যায় কাজে সাহায্য করা হয়। আর আল্লাহ তাআলা অন্যায় কাজে সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ করেছেন। তবে যদি টাকা রাখার মতো অন্য কোনো ব্যাংক না পাওয়া যায় তাহলে অপারগতা বশত এমন ব্যাংকে টাকা রাখলে কোনো সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ। ইরশাদ হয়েছে- অথচ তিনি তোমাদের জন্য বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, যা তোমাদের উপর হারাম করেছেন। তবে যার প্রতি তোমরা বাধ্য হয়েছে।[৯৭] অতএব টাকা রাখার জন্য যখন কোনো ইসলামি কায়দায় পরিচালিত ব্যাংক অথবা নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যাবে- যেখানে অন্যায়ে সহযোগিতা দানের অপরাধ হবে না তখন সুদী ব্যাংকে টাকা রাখা জায়িয হবে না।[৯৮]

একাদশ মাসআলা : ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়

প্রশ্ন: এভাবে ব্যাংকের শেয়ার কেনার হুকুম কী যে কিছুদিন পর তা এক হাজার টাকা থেকে উন্নীত হয়ে ১৩০০ টাকা হয়ে যাবে। এটা কী সুদ বলে গণ্য হবে?

উত্তর: ব্যাংকের শেয়ার কেনাবেচা করা জায়িয নেই। কারণ এটা হস্তগত করা এবং সমতা রক্ষার শর্ত পুরণ না করে মুদ্রার বিনিময়ে মুদ্রা বেচার শামিল- যা হারাম। দ্বিতীয়ত এটা সুদী প্রতিষ্ঠান যেখানে কোনো রূপ সাহায্য করা বৈধ নয়। কারণ ইরশাদ হয়েছে- 'সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।'[৯৯] এবং এ জন্য যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি সুদদাতা, গ্রহীতা, সুদের লেখক এবং সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ দিয়েছেন। আখ্যায়িত করেছেন এদের সকলকে সমান অপরাধী বলে।[১০০]

১৭. তবে আপনি এবং সকল মুসলমানের প্রতি আমার অনুরোধ, যে কোনো মূল্যে সব ধরণের সুদী লেনদেন থেকে বিরত থাকুন। আর অতীত লেনদেনের জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করুন। কারণ সুদী লেনদেন করার অর্থ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। আল্লাহর গোস্বা ও আজাবকে অবধারিত করা। তিনি যেমন ইরশাদ করেছেন- 'যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।

আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদাকাকে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অতি কুফরকারী পাপীকে ভালবাসেন না।[১০১] তিনি আরও ইরশাদ করেন- 'হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও।'[১০২] আর এ সম্পর্কে হাদিস তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। [১০৩]

দ্বাদশ মাসআলা : সুদী প্রতিষ্ঠানে চাকুরি

প্রশ্ন: সুদী প্রতিষ্ঠানে কি নিরাপত্তারক্ষী বা ড্রাইভার হিসেবে চাকুরি করা যাবে ?

উত্তর: কোনো সুদী প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করা বৈধ নয় চাই তা দারোয়ান-ড্রাইভার যে হিসেবেই হোক না কেন। কারণ সুদী প্রতিষ্ঠানের যে কোনো দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়া মানেই তাদের হারাম কাজে সম্মতি জানানো। কেননা যে কোনো কিছু ঘৃণা করে তার স্বার্থে সে কাজ করতে পারে না। সুতরাং সে যখন সুদী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে তার অর্থ এতে তার সমর্থন আছে। আর হারাম কাজে সমর্থন দেয়াও গুনাহ। আর যে সরাসরি হিসাব রক্ষণ, রেজিস্ট্রি, আমানত গ্রহণ বা এ ধরণের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অবতীর্ণ তার চাকুরি তো সন্দেহাতীতভাবে হারাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি সুদদাতা, গ্রহীতা, সুদের লেখক এবং সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ দিয়েছেন। আখ্যায়িত করেছেন এদের সকলকে সমান অপরাধী বলে।[১০৪]

ত্রয়োদশ মাসআলা : সুদী ব্যাংকের লাভ

প্রশ্ন: কিছু কিছু ব্যাংক তাদের কাছে টাকা আমানত রাখলে তার ওপর লাভ দিয়ে থাকে। আমরা জানি না লাভগুলো সুদ না-কি লাভ যা গ্রহণ করা বৈধ?

উত্তর: প্রথমত. ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের গচ্ছিত টাকার ওপর যে লাভ দেয় তাকে সুদ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ টাকা ভোগ করা বৈধ নয়। তার কর্তব্য সুদী ব্যাংকে টাকা রাখার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং মূল টাকা লাভসহ প্রত্যাহার করে নেয়া। তারপর মূল এমাউন্ট সংরক্ষণ করবে আর লভ্যাংশটুকু গরিব-মিসকিন এবং জনহিতকর খাতে ব্যয় করা। দ্বিতীয়ত. সুদী কারবার করে না এমন ক্ষেত্র খুঁজে বের করবে। হোক না সেটা দোকান বা অন্য কিছু। সেখানে টাকা রাখবে ব্যবসায় খাটানোর জন্য কিংবা অলাভজনক আমানত হিসেবে।[১০৫]

চতুর্দশ মাসআলা : বার্ষিক লাভের ওপর ব্যাংকের ঋণ দান

প্রশ্ন: ব্যাংকের সাথে লেনদেন করা কি সুদ নাকি অবৈধ? অনেক নাগরিকই তো ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়।

উত্তর: মুসলমানের জন্য সোনা, রুপা বা কাগজের মুদ্রা কর্জ নেয়া এ হিসেবে তার চেয়ে পরিশোধ করবে হারাম। চাই ঋণদাতা ব্যাংক হোক বা অন্য কেউ। কারণ এটা সুদ- যা অন্যতম কবিরা গুনাহ। যে ব্যাংক এ কাজ করে সেটা সুদী ব্যাংক।[১০৬]

পঞ্চদশ মাসআলা : একরকম মুদ্রা নিয়ে অন্যরকম মুদ্রা দিয়ে পরিশোধ করা

প্রশ্ন: আমাকে এক ভাই দুই হাজার তিউনিসি মুদ্রা কর্জ দিলেন। চুক্তিপত্র লেখার সময় টাকার অঙ্ক উল্লেখ করা হলো জার্মানি মুদ্রায়। তারপর ঋণের মেয়াদ তথা বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর দেখা গেল জার্মানি মুদ্রার মান বেড়ে গেছে। ফলে আমি যখন চুক্তিনামায় উল্লেখিত পরিমাণ টাকা পরিশোধ করলাম, দেখা গেল তাকে তিনশ তিউনিসি মুদ্রা বেশি দেয়া হয়েছে। এখন জিজ্ঞাস্য হলো, আমার ঋণদাতার জন্য এ অতিরিক্ত টাকা নেয়া বৈধ হবে কি? নাকি তা সুদ বলে গণ্য হবে? প্রকাশ থাকে যে, সে চায় আমি জার্মানি মুদ্রায় তার প্রাপ্য টাকা পরিশোধ করি। যেন সে জার্মানি থেকে গাড়ি কিনতে পারে।
উত্তর: ঋণদাতার জন্য আপনাকে যত টাকা কর্জ দিয়েছে অর্থাৎ দুই হাজার তিউনিসি মুদ্রা-এর অতিরিক্ত নেয়া বৈধ হবে না। তবে আপনি যদি উদারতা দেখিয়ে একটু বেশি দেন সেটা ভিন্ন কথা। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-'লোকদের মধ্যে সেই উত্তম যে তাদের মাঝে ঋণ পরিশোধের বেলায় উত্তম।' হাদিসটি এভাবে মুসলিম শরিফে বর্ণিত হয়েছে।[১০৭] বুখারিতে এসেছে এভাবে- 'সর্বোত্তম লোকদের মধ্যে অন্যতম সেই ব্যক্তি যে ভালোভাবে কর্জ আদায় করে।'[১০৮]

আর উল্লেখিত চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে। এর কোনো মূল্য নেই। আমলও করা হবে না সে অনুযায়ী। কারণ এটা শরিয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ চুক্তি। শরিয়তের অসংখ্য দলিল প্রমাণ করে যে, কর্জ নেয়া টাকা তার অনুরূপ পরিমাণ দিয়েই পরিশোধ করতে হয়। তবে যদি ঋণগ্রহীতা উপকারের বদলা হিসেবে কিছু বেশি দেয় তাহলে সেটা উল্লেখিত হাদিসের কারণে বৈধ হবে।[১০৯]
প্রশ্ন: আমার এক মিশর প্রবাসী আত্মীয় আমার কাছে ২৫০০ মিশরি পাউন্ড কর্জ চাইলেন। আমি তার উদ্দেশে ২০০০ ডলার পাঠালাম- যা বিক্রি করে তিনি ২৪৯০ মিশরি পাউন্ড পেলেন। তখন আমরা পরিশোধের ধরন বা তারিখ কোনোটাই উল্লেখ করিনি। ইদানীং তিনি আমার প্রাপ্য পরিশোধ করতে চাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হলো, আমি কি তার থেকে ২৪৯০ মিশরি পাউন্ড নিব- যা বর্তমানে ১৮০০ ডলার সম পরিমাণ না-কি ২০০০ ডলার- যা তাকে ২৮০০ মিশরি পাউন্ড দিয়ে কিনতে হবে?
উত্তর: তার জন্য ওয়াজিব যত ডলার সে কর্জ নিয়েছে তা-ই পরিশোধ করা। কারণ এটাই মূল এমাউন্ট যা সে কর্জ নিয়েছে। তবে উভয়ে একমত হয়ে যদি আপনি পাউন্ড নিতে রাজি হন তাহলে কোনো সমস্যা নেই। ইবনে উমর রা. বলেন, 'আমরা বকি' নামক স্থানে দিরহাম দিয়ে উট বিক্রি করতাম পরে আবার দিরহামের বদলে দিনার গ্রহণ করতাম। তেমনি দিনার দিয়ে উট বিক্রি করতাম তারপর দিরহাম গ্রহণ করতাম। এতদশ্রবণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, 'যতক্ষণ তোমরা (চুক্তির স্থান থেকে) আলাদা না হবে ততক্ষণ বিক্রিত উট তার মূল্য দিয়ে (সেটা যা-ই হোক না কেন) বিক্রি করায় কোনো সমস্যা নেই।[১১০] আলোচ্য মাসআলায় মুদ্রা বিক্রি করা হচ্ছে ভিন্ন জাতের মুদ্রা দিয়ে যা ঠিক স্বর্ণ দিয়ে রৌপ্য বিক্রির মতো।

সুতরাং আপনারা যখন একমত যে তিনি আপনাকে ডলারের পরিবর্তে মিশরি পাউন্ড দিবেন এ শর্তে যে একমত হওয়ার সময়ের চেয়ে বেশি মূল্য নিবেন না তাহলে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। অতএব আজ যদি ২০০০ ডলারের মূল্য হয় ২৮০০ পাউন্ড তাহলে আপনি ৩০০০ পাউন্ড নিতে পারবেন না। হ্যা শুধু ২৮০০ পাউন্ড নিতে পারবেন আবার শুধু ২০০০ ডলারও নিতে পারবেন। অর্থাৎ আপনি হয়তো আজকের দরে নিবেন নয়তো তার চেয়ে কমে। এককথায় বেশি নিতে পারবেন না। বেশি নিলে সেটা আপনার দায়িত্ব বহির্ভূত লাভ বলে গণ্য হবে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দায় বহির্ভূত লাভ গ্রহণ থেকে বারণ করেছেন। তবে যদি কম নেন তাহলে ধরা হবে যে, আপনি কিছু নিয়েছেন আর বাকিটা ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর এতে কোনো সমস্যা নেই।[১১১]

ষষ্ঠদশ মাসআলা : এমন কর্জ যা লাভ টেনে আনে

প্রশ্ন: একব্যক্তি একজনের কাছ থেকে কিছু অর্থ ঋণ নিয়েছে। তবে ঋণদাতা শর্ত দিয়েছে এর জন্য তার কাছে একটি ধানী জমি বন্ধক রাখতে হবে। সে ওই জমি চাষাবাদ করবে আর উৎপাদিত ফসলের পুরোটা বা অর্ধেক নিয়ে নিবে। বাকি অর্ধেক নিবে জমির মালিক। যতদিন এ ব্যক্তি তার ঋণ পুরোপুরি শোধ না করতে পারবে ঋণদাতা এ জমি ভোগ করবে। প্রশ্ন হলো এমন করা তার জন্য জায়িয হবে কি? এ ধরনের শর্তযুক্ত ঋণের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে?

উত্তর: কর্জ হলো অন্যের প্রতি দয়া ও সহমর্মিতার পরিচায়ক লেনদেনের অন্যতম। ইসলাম এমন লেনদেনর বহুল প্রচার কামনা করে। কেননা কর্জ দ্বারা অন্যের উপকার ও তার ওপর অনুগ্রহ করা হয়। আর আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- তোমরা অনুগ্রহ করো আল অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন।[১১২] সুতরাং ঋণ দেয়া মুস্তাহাব ও প্রশংসনীয় কাজ আর ঋণ নেয়া মুবাহ ও বৈধ কাজ।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি এক ব্যক্তি থেকে একটি বাচ্চা উট ধার নিয়েছেন এবং তার চেয়ে উত্তমটা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আর কর্জ দেয়া যেহেতু অনুগ্রহ ও দয়াপূর্ণ চুক্তি তাই এটাকে লাভ ও বিনিময় চুক্তি তথা নিছক পার্থিব লাভ আহরণের উপায়ে পরিণত করা বৈধ নয়। কারণ এমন করার দ্বারা একটা পুণ্যকর্মকে ভোগসর্বস্ব ব্যবসায়িক লেনদেনে পরিণত করা হয়। এ জন্যই আপনি এ দুই কথার মধ্যে পার্থক্য পাবেন যে বলল, আমি তোমাকে এই দিনারের বিনিময়ে এই দিনার এক বছরের জন্য বাকিতে দিলাম অথবা আমি তোমার কাছে এতগুলো দিনারের বদলে এতগুলো দিনার বিক্রি করলাম। অতপর হস্তগত না করেই দু'জন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারণ উভয় অবস্থায়ই হারাম হবে। কিন্তু যদি তাকে এক দিনার কর্জা দেয় আর সে তা শোধ করে এক মাস বা এক বছর পরে তাহলে সেটা বৈধ। অথচ এখানেও ঋণদাতা বিনিময়টা এক বছর পরে বা তার আগে-পিছে গ্রহণ করছে। এটা এ জন্য যে এখানে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা ও দয়ার দিকটিই প্রাধান্য পাচ্ছে।

আর এর ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, আপনার জিজ্ঞাস্য ক্ষেত্রে ঋণদাতা যেহেতু নিছক জাগতিক লাভের শর্ত করেছে সুতরাং এটা কর্জার উপকারী মনোভাব থেকে বেরিয়ে গেছে। অতএব এ সুরত হারাম। এছাড়া ফিকাহবিদদের স্বীকৃত মূলনীতি তো আছেই যে, 'প্রত্যেক ওই কর্জ যা লাভ টেনে আনে তা সুদ।' সুতরাং বুঝা গেল, কর্জদাতার জন্য বৈধ হবে না যে তিনি কর্জগ্রহীতার ওপর তার জমি অর্পণের শর্ত করবেন যা চাষাবাদ করে তিনি ভোগ করবেন। এমনকি যদি ঋণগ্রহীতা এক ভাগ দেয় তাও বৈধ হবে না। কারণ এটা সুস্পষ্টভাবে কর্জ দিয়ে লাভ নেয়ার শামিল যা কর্জের মতো একটি সুন্দর সহমর্মিতা মূলক লেনদেনকে বস্তু ও সার্থ সর্বস্ব লেনদেনে পরিণত করে।[১১৩]

সপ্তদশ মাসআলা : ব্যাবসায়িক বীমা এবং ব্যাংক গ্যারান্টি

প্রশ্ন: আমরা এমন সমস্যায় আছি যে ব্যাংকের সাথে কারবার না করে উপায় নাই। ব্যাপার হলো, আমরা একটি ব্যাংককে ঠিকাদার নিযুক্ত করেছি; যেটির নাম 'সুন্দর ব্যবস্থাপনা ঠিকাদারি ব্যাংক (অর্থাৎ ব্যাংকটি চুক্তির ধারা অনুযায়ী সুন্দরভাবে চুক্তি বাস্তবায়নের জামিন হয়।) এখন আমরা সবিস্ময়ে জানছি, তারা যে জামিননামা পেশ করে তার বিনিময়ে মূল্য নেয়। এদিকে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ফিকহের কিতাব রয়েছে যেগুলো থেকে জানা যায়, জিম্মাদারি বা গ্যারান্টি একধরনের স্বেচ্ছাসেবা। এরপর আমরা প্রজেক্টি স্থগিত করেছি বিষয়টি সম্পর্কে শরয়ি প্রমাণাদিসহ বিস্তারিত জানার জন্য। জিজ্ঞাস্য হলো, জামিন বা গ্যারান্টার হওয়ার বিনিময়ে মূল্য নেয়া কি জায়িজ ?

তেমনি ব্যবসায়িক পণ্যের বীমা, জীবন বীমা এবং এ ধরনের চুক্তির ব্যাপারে শরিয়তের বক্তব্য কী আমাদের জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর: প্রথমত. যে আপনাদের কোনো চুক্তি বাস্তবায়নে জামিন হয়েয়ে তার জন্য যে নির্ধারিত এমাউন্টের বেশি লাভের ওপর জামিন হওয়া জায়িজ নেই। কারণ সে মুনাফা নিবে তা সুদী মুনাফা যা হারাম। দ্বিতীয়ত. ব্যাবসায়িক বীমা হারাম। নিম্নের কারণগুলোর ভিত্তিতে।
১. ব্যবসায়িক বীমা চুক্তি এক ধরনের অনিশ্চিত মুয়ামালা যাতে আছে নির্জলা প্রতারণা। কারণ বীমাকারী চুক্তির সময় জানতে পারে না কত টাকা তাকে দেয়া হবে। তাই দেখা যায় বীমাকারী হয়তো এক বা দুই কিস্তি দিয়েছে মাত্র; অমনি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। তখন সে বীমা কোম্পানি কর্তৃক ধার্যকৃত এমাউন্টের মালিক হয়। আবার কারো বেলায় দেখা যায় দুর্ঘটনা ঘটেই না। তখন সে সব কিস্তি পরিশোধ করেও কিছুই পায় না। আর কোম্পানিও নিশ্চিত করে জানতে পারে না প্রত্যেক চুক্তির বেলায় কত পাবে আর কত দিবে। কারণ সহি হাদিসে ধোঁকা-প্রতারণামূলক ব্যবসা বৈধ নয়।[১১৪]
২. ব্যবসায়িক বীমা এক ধরনের জুয়া। কারণ এতে 'আর্থিক লেনদেনে শংকা' রয়েছে, রয়েছে কোনো অপরাধ বা ভূমিকা ছাড়া ক্ষতি পূরণ এবং বিপরীতে কিছু ছাড়া মুনাফা বা বিনিময় ছাড়া প্রতিদান। দেখা যায় বীমাকারী মাত্র এক কিস্তি দিয়েছে ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে দুর্ঘটনা তখন বীমা কোম্পানি এর দায় বহন করে। আবার কারো বেলায় দুর্ঘটনা ঘটেই না। অথচ কোম্পানি তারপরও কোনো বিনিময় ছাড়াই সমুদয় কিস্তি গ্রহণ করে। এসবের সাথে সাথে যখন তাতে অজ্ঞতা যোগ হয় তখন তা হয়ে যায় পুরোমাত্রায় জুয়া। ফলে তখন এটি কুরআনে বর্ণিত 'মাইসির' এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ইরশাদ হয়েছে- 'হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা- বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।'[১১৫]
৩. ব্যবসায়িক বীমায় নাসিয়া ও ফযল উভয় ধরনের সুদ রয়েছে। কারণ কোম্পানি যখন বীমাকারী বা তার উত্তরাধীকারীদের জমা দেয়া টাকার অতিরিক্ত দিবে তখন তা রিবায়ে ফযল বা অতিরিক্ত নেয়ার মাধ্যমে সুদ হবে। এদিকে কোম্পানি যেহেতু চুক্তির পরে শোধ করে তাই তা রিবায়ে নাসিয়া বা বাকি দেয়ার মাধ্যমে সুদ হবে। আর যদি মুনাফা না দিয়ে সমান দেয় তবুও তা হবে রিবায়ে নাসিয়া বলে গণ্য হবে। আর উভয় অবস্থায়ই হারাম।
৪. ব্যবসায়িক বীমা এক ধরনের বাজি। যার উভয় তরফেই রয়েছে অজ্ঞতা, প্রতারণা এবং জুয়া। আর ইসলামে বাজি সম্পূর্ণ হারাম। কেবল ওইসব ক্ষেত্রে যেখানে ইসলামের কলম বা কথা দ্বারা ইসলামের বিজয় সাধন উদ্দেশ্য হয়। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাজি বৈধতা তিন ক্ষেত্রেই সীমিত রেখেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, .....
৫. বীমা চুক্তিতে বিনিময় ছাড়া অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করা হয় বলে তা আল্লাহর বাণী 'হে মুমিনগণ তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু।'[১১৬]- এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়ে হারাম হবে।
৬. ব্যবসায়িক বীমায় শরিয়ত যেটার ওপর মানুষকে বাধ্য করেনি সেটাতে বাধ্য করা হয়। কারণ কোম্পানি দুর্ঘটনা ঘটায় না; এর পেছনে তার কোনো হাতও থাকে না। কোম্পানি শুধু দুর্ঘটনার ক্ষতি বহনের গ্যারান্টি দিয়ে বীমাকারীর কাছ থেকে নির্ধারিত এমাউন্ট নিয়েছে। কোম্পানি বীমাকারীর জন্য এতটুকু শ্রম দেয়নি। সুতরাং এটা হারাম হবে।[১১৭]

এ কথা আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, জীবন বীমা ও বাণিজ্যিক বীমা নিম্নোক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে অবৈধ-

১. বীমার মধ্যে সুদ রয়েছে। কারণ কোনো কোনো বীমায় লাভ দেয়া হয়। যেমন- জীবন বীমা। এতে কোম্পানি বীমাকারীকে তার সঞ্চিত পরিমাণের চেয়ে বেশি সুদসহ দেয়া হয়। বীমাকারী দেয় কম অথচ পায় তার চেয়ে বেশি।
২. বীমা মানুষকে অবৈধভাবে অন্যের সম্পদ ভোগে বাধ্য করে।
৩. বীমায় জুয়া রয়েছে। কারণ এটি ঝুঁকির ওপর কৃত চুক্তি- যা কখনো ঘটে; কখনো ঘটে না। সুতরাং এটি একধরনের জুয়া।
৪. বীমায় ধোঁকা-প্রতারণা ও অজ্ঞতা রয়েছে।
৫. বীমা চুক্তিকারীদ্বয়ের মাঝে অবিশ্বাস ও শত্রুতা সৃষ্টি করে। কারণ যখন দুর্ঘটনা ঘটবে তখন উভয়পক্ষ চাইবে ক্ষতির দায়দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপাবে। এতে করে ঝগড়া-বিবাদ এবং বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে।
৬. বীমা এমন কোনো ব্যবস্থা নয় যা ছাড়া চলবে না। কারণ বীমার এ কাজের জন্য ইসলাম বিভিন্ন উপলক্ষে দান-সদকার নিয়ম প্রবর্তন করেছে। এবং গরিব-মিসকিন ও ঋণগ্রস্থদের সহযোগিতার উদ্দেশ্যে জাকাত ওয়াজিব করেছে। এ ছাড়াও ইসলামি রাষ্ট্র তার সকল প্রজার দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করে।[১১৮]

পঞ্চম পর্ব
সুদের ক্ষতি-অপকারিতা-কুপ্রভাব

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, সুদের রয়েছে অনেক বড় বড় অপকারিতা এবং মারাত্মক শাস্তি। ইসলাম মানুষকে যা-ই করতে বলে তার মাঝে তার সৌভাগ্য এবং দুনিয়া-আখিরাতের সম্মান নিহিত থাকে। তেমনি ইসলাম এমন জিনিস থেকেই বারণ করে যার মাঝে তার দুর্ভাগ্য এবং উভয় জগতের ক্ষতি রয়েছে। হ্যা, সুদেরও আছে অনেক অকল্যাণকর দিক। তার মধ্য হতে কয়েকটি। যেমন-

১. সুদের আত্মিক-চারিত্রিক ক্ষতি : সুদ ভক্ষণেচ্ছা যাদের রয়েছে তাদের চরিত্র নিয়ে ভাবলেই বুঝা যায় এর ক্ষতি কতটুকু। কারণ, সমাজে আমরা তাদেরকেই সুদী কারবার করতে দেখি যাদের অন্তরে কৃপণতা, নির্দয়তা, অর্থলিপ্সা এবং বস্তু লোলুপতা প্রভৃতি বদগুণ স্থান করে নিয়েছে।
২. সুদের সামাজিক ক্ষতি : যে সমাজে সুদী লেনদেন হয় সেটা ভ্রষ্ট, অন্তসার শূন্য সমাজ। যেখানে একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসে না। কেউ কারো সামান্য উপকার করে না স্বার্থ ছাড়া। এ সমাজের বিত্তশালীরা নিঃস্বদের ঘৃণা করে। বলাবাহুল্য যে, এমন সমাজে কখনো ঐক্য-স্থিতি টিকে থাকতে পারে না। এর সদস্যরা অনৈক্য ও অশান্তির দিকে ঝুঁকে থাকে সদা সর্বদা।
৩. সুদের অর্থনৈতিক ক্ষতি : সুদ সমাজ জীবনের সকল লেনদেনের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্ক রাখে। কারণ সমাজের সবাই কমবেশি কর্জ দেয়া-নেয়া করে।

আর কর্জ কয়েক প্রকার : যথা-

(ক) এমন কর্জ যেটা অভাবী শ্রেণী তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণের অভিপ্রায়ে গ্রহণ করে। ঋণের এই সনাতনী ধারাকে অবলম্বন করেই সুদী কারবার সবচে বেশি প্রসারতা লাভ করেছে। এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই সুদী ব্যবসা যার রাহুগ্রাস থেকে খুব কম সংখ্যক দেশই নিরাপদ আছে। যে ব্যক্তিই এ সুদী চক্রের কব্জায় একবার এসেছে আমৃত্যু সে এর নাগপাশ থেকে মুক্তি পায় না।
(খ) এমন কর্জ যেটা ব্যবসায়ী, নির্মাতা এবং ভূ-স্বামীগণ গ্রহণ করে থাকে তাদের সফল প্রকল্পগুলোয় কাজে লাগানোর জন্য।
(গ) এমন ঋণ যা কোনো দেশ অন্য দেশের অর্থবাজার থেকে গ্রহণ করে থাকে তার প্রয়োজন মেটাবার নিমিত্তে।

ঋণের সবগুলো প্রকারই সমাজের প্রভুত দুর্দশা ও অকল্যাণ বয়ে আনে। চাই ঋণ নেয়া হোক ব্যবসা বা কারখানার জন্য, চাই ঋণ গ্রহণ করুক গরিব রাষ্ট্র ধনী রাষ্ট্রের কাছ থেকে। কারণ সবগুলোই এমন ব্যাপক অনিষ্ট ডেকে আনে যা থেকে ওই সমাজ বা রাষ্ট্র সহজে পরিত্রাণ পায় না। এটা হচ্ছে শুধু ইসলামি পদ্ধতির অনুসরণ না করার ফলেই। যে ইসলাম মানুষকে সব রকম কল্যাণের দিকে আহ্বান জানায়। নির্দেশ দেয় গরিব, মিসকিন ও অভাবীদের প্রতি দয়া, অনুগ্রহ ও সহমর্মিতা দেখাতে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- 'সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।'[১১৯] তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন মুসলমানদের পরস্পর দয়া, সহানুভূতি দেখাতে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকতে। তিনি ইরশাদ করেন- 'মুসলমান মুসলমানের জন্য প্রাচীরের মতো যার এক অংশ অপর অংশের সঙ্গে বাঁধা আছে। এ বলে তিনি তাঁর এক হাতের আঙ্গুল অপর হাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেখালেন।[১২০] তিনি আরও বলেন, পরস্পর ভালোবাসা, সৌহার্দ্য এবং একতার দিক দিয়ে মুমিনদের দৃষ্টান্ত এক দেহের ন্যায়। যখন তার কোনো অঙ্গ অসুস্থ হয় তখন তার সব অঙ্গই জ্বর বা জাগরণের মাধ্যমে সাড়া দেয়।[১২১]

সুতরাং বুঝা গেল, বিপদ থেকে বাঁচতে হলে, কল্যাণ ও মুক্তি নিশ্চিৎ করতে হলে ইসলাম ও ইসলামি আদর্শের কোনো বিকল্প নেই।
৪. সুদ মানুষের কর্ম-শক্তিকে অকার্যকর বানিয়ে দেয়। কেননা সুদ থেকে যখন চাহিদা মেটাতে পারে সুদী কারবারি তখন বেকারত্ব ওপরই সন্তুষ্ট থাকে।
৫. ইসলামি সমাজগুলো পর্যন্ত সুদের দাবানল থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না।
৬. মানুষের কাছে অলস বেকার টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৭. অর্থনীতি বিকৃত ও ভ্রান্ত পথে হাঁটতে শুরু করেছে।
৮. মুসলমানদের সম্পদ তাদের শত্রুদের হাতে চলে যাচ্ছে। এটা মুসলমানদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক ব্যাপার। কারণ তারা তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ কাফেরদের ব্যাংকগুলোয় জমা রাখছে। এর দ্বারা তারা যেমন আমাদের বিরুদ্ধে আমাদেরই টাকা নিয়ে শক্তিশালী হচ্ছে তেমনি সে টাকা দিয়ে আমাদেরকেই দুর্বল বানানোর চেষ্টা করছে। তাছাড়া তাদের কাছে টাকা গচ্ছিত রাখার কারণে মুসলমানরা উপকরণ সল্পতারও শিকার হচ্ছে।
৯. সুদ আল্লাহর দুশমন অভিশপ্ত ইহুদিদের স্বভাব-আমল। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- 'আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।'[১২২]
১০. সুদ বর্বরযুগের লোকদের স্বভাব। যে সুদী কারবার করে যে বর্বরদের গুণে গুণান্বিত হয়।
১১. সুদখোরকে কিয়ামতের দিন পাগল হিসেবে পুনরুত্থিত করা হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-' যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।'[১২৩]
১২. আল্লাহ তাআলা সুদের মাধ্যমে আহরিত সম্পদ ধ্বংস ও নির্মূল করেন। ইরশাদ হয়েছে- 'আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদাকাকে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অতি কুফরকারী পাপীকে ভালবাসেন না।'[১২৪] ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- সুদ যদিও সম্পদ বাড়ায় কিন্তু শেষ পরিণামে তা কমায়।[১২৫]
১৩. সুদী কারবার বান্দাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ করে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- 'হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলম করবে না এবং তোমাদের যুলম করা হবে না।'[১২৬]
১৪. সুদ ভক্ষণ খোদাভীতি, তাকওয়া শূন্যতা এবং দুর্বলতার প্রমাণ বহণ করে। যা মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে ব্যর্থ ও হতভাগ্য মানুষে পরিণত করে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- 'হে মুমিনগণ, তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও। আর তোমরা আগুনকে ভয় কর, যা কাফিরদের জন্য তৈরি করা হয়েছে।'[১২৭]
১৫. সুদ খেলে মানুষ লালত ও অভিশাপের ভাগী হয়। দূরে চলে যায় আল্লাহর রহমত থেকে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম 'সুদদাতা, গ্রহীতা, সুদ-চুক্তির লেখক ও সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ দিয়েছেন।' তিনি বলেছেন, 'তারা সবাই সমান অপরাধী।'[১২৮]
১৬. সুদখোরকে মৃত্যুর পর রক্তের নদীতে সাঁতরানোর শাস্তি দেয়া হবে। সে সাঁতরাবে আর তাকে পাথর ছুড়ে নদীর মাঝখানে পৌঁছে দেয়া হবে। সামুরা রা. থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসের শেষে বলা হয়েছে 'আমি যাকে নদীর মাঝে দেখেছি সে হলো সুদখোর।[১২৯]
১৭. সুদ মানুষকে মারাত্মকভাবে ধ্বংসকারী বিষয়গুলোর অন্যতম। আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'ধ্বংসকারী সাতটি জিনিস থেকে বেঁচে থাক। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, সেগুলো কী কী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, শিরক করা, যাদু করা, অনুমোদিত কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের মাল ভক্ষণ করা, জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং মুমিনা সরলা সতী নারীকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া।[১৩০]
১৮. সুদ খাওয়া শাস্তি ও ধ্বংসের কারণ হয়। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'যখন এলাকায় সুদ ও ব্যভিচার প্রকাশ পাবে তখন বুঝতে হবে তারা নিজেদের ওপর আল্লাহর শাস্তি হালাল করে নিয়েছে।'[১৩১]
১৯.নিকৃষ্টতম কাজের মধ্যে তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে এই সুদের। যেমন-আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'সুদের তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে। সর্বনিম্নটি হলো নিজের মায়ের সঙ্গে জেনা করার মতো। আর অপর ভাইয়ের সম্মান নষ্ট করা সবচে' নিকৃষ্ট সুদ।[১৩২]
২০. সুদ খাওয়ার অর্থ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরুদ্ধাচারণ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- 'অতএব যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌঁছার ভয় করে।'[১৩৩] 'আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে এবং তাঁর সীমারেখা লঙ্ঘন করে আল্লাহ তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর তার জন্যই রয়েছে অপমানজনক আযাব।'[১৩৪] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন- 'আর আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।[১৩৫] আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাতে তারা চিরস্থায়ী হবে।'[১৩৬]
২১. সুদখোরকে জাহান্নামের ভয় দেখানো হয়েছে যদি সে তওবা না করে। আল্লাহ তাআলা বলেন- 'অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।'[১৩৭]
২২. আল্লাহ তাআলা সুদের অর্থ দিয়ে সদকা করলে সেটা গ্রহণ করেন না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- 'আল্লাহ তাআলা পবিত্র তিনি শুধু পবিত্র মালই গ্রহণ করেন।'[১৩৮]
২৩. সুদখোরের দুআ কবুল হয় না। আবু হোরায়রা রা. বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওই ব্যক্তির কথা বলেন, যে প্রায়শই দীর্ঘ ভ্রমণে থাকে। তার কেশ এলোমেলো আর বেশ আলুথালু। আকাশ পানে হাত প্রসারিত করে সে বলে, হে রব, হে রব, অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং ভরণপোষণও হারাম তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এর দুআ কীভাবে কবুল হবে? (তার দুআ কবুল করা হয় না।)
২৪. সুদ খেলে অন্তর কঠোর হয় এবং তাতে মরচে পড়ে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, 'কখনো নয়, বরং তারা যা অর্জন করত তা-ই তাদের অন্তরসমুহকে ঢেকে দিয়েছে।'[১৩৯] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- 'তোমরা জেনে নাও নিশ্চয় দেহের মধ্যে একটি মাংসপিণ্ড আছে যদি তা ঠিক তাহলে সারা দেহ সুস্থ, যখন তা অসুস্থ হয় সারা দেহ অসুস্থ হয়ে পড়ে।[১৪০]
২৫. সুদ খাওয়া হালাল রিজিক থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- 'সুতরাং ইয়াহূদীদের যুলমের কারণে আমি তাদের উপর উত্তম খাবারগুলো হারাম করেছিলাম, যা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছিল এবং আল্লাহর রাস্তা থেকে অনেককে তাদের বাধা প্রদানের কারণে। আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।'[১৪১]
২৬. সুদ খাওয়া জুলুম বা অন্যায় আর সকল জুলুম কিয়ামতের দিন ঘোর তমসা ডেকে আনবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- 'আর যালিমরা যা করছে, আল্লাহকে তুমি সে বিষয়ে মোটেই গাফেল মনে করো না, আল্লাহ তো তাদের অবকাশ দিচ্ছেন, ঐ দিন পর্যন্ত যে দিন চোখ পলকহীন তাকিয়ে থাকবে। তারা মাথা তুলে দৌড়াতে থাকবে, তাদের দৃষ্টি নিজদের দিকে ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে শূন্য।'[১৪২]
২৭. সুদখোর কল্যাণ আহরণের যাবতীয় উপলক্ষ্য থেকে বঞ্চিত হয়। তাই সে উত্তম ঋণ দেয় না, অভাবীর প্রতি লক্ষ্য করে না এবং দুর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তির কষ্ট দূর করে না। কারণ তার পক্ষে বোধগম্য স্বার্থ ছাড়া অর্থ নিয়োগ কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ আল্লাহ তাআলা যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে সাহায্য করে এবং তার বিপদ দূর করে তার ফজিলত বলে দিয়েছেন। হাদিসগ্রন্থগুলোয় এসেছে-
আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় তার মুমিন ভাইয়ের বিপদ দূর করবে আল্লাহ তাআলা তার বিপদ দূর করবেন দুনিয়া ও আখিরাতে। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে ছাড় দিবে আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়া-আখিরাতে ছাড় দিবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে আল্লাহ তাআলা উভয় জগতে তার দোষ গোপন করবেন। আর বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সহযোগিতায় থাকে আল্লাহ ততক্ষণ তার সাহায্যে থাকেন।[১৪৩]

আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- মুসলমান মুসলমানের ভাই- তার ওপর জুলুম করে না; তাকে একাকী ছেড়েও দেয় না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের কষ্ট লাঘব করবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার কষ্ট লাঘব করবেন। আর যে তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ গোপন রাখবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন।[১৪৪]

তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি অভাবী লোককে সুযোগ দিবে অথবা তার প্রাপ্য মাফ করে দিবে আল্লাহ তাআলা তাকে নিজ ছায়াতলে স্থান দিবেন।[১৪৫]
২৮. সুদ মানুষের সৌহার্দ্য-সহানুভূতির চেতনাকে গলা টিপে হত্যা করে। কারণ ঋণী ব্যক্তির সকল সম্পদ হাতছাড়া হতে দেখেও সুদখোরের অন্তরে মায়া জাগে না। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- 'দয়া-মায়া তার অন্তর থেকেই ছিনিয়ে নেয়া হয় যে হতভাগার দলে যোগ দিয়েছে।'[১৪৬] তিনি আরও বলেন, 'আল্লাহ তার ওপর দয়া দেখান না যে মানুষকে দয়া করে না।'[১৪৭] অন্য হাদিসে তিনি বলেন, 'দয়াকারীদের ওপর দয়াবান-রহমান দয়া করেন। তোমরা জমিনবাসীদের ওপর দয়া করো; আসমানবাসী তোমাদের ওপর দয়া করবেন।[১৪৮]
২৯. সুদ ব্যক্তি এবং দলের মাঝে হিংসা ও শত্রুতা সৃষ্টি করে। অনৈক্য এবং বিশৃংখলা উস্‌কে দেয়।[১৪৯]
৩০. সুদ মানুষকে এমন সব কাজে উদ্বৃদ্ধ করে যার ফলাফল তার সহ্য ক্ষমতার বাইরে।

এ ছাড়াও সুদের অনেক ক্ষতি রয়েছে যা গণনা করে শেষ করা যাবে না। তবে আমাদের জন্য এতটুকু মনে রাখাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা সেটাই হারাম করেন যার মাঝে শুধু অনিষ্ট ও অকল্যাণই রয়েছে। যার লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। পরিশেষে আমি নিজের এবং সকল মুসলমানের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রত্যাশা করছি।

--------------------------------------------------------------------------------

[১]. হজ : ০৫
[২]. নাহল : ৯২
[৩]. মুগনি : ৬/৫১
[৪]. শরহুন নাবাবি আলা মুসলিম: ৮/১১, ফাতহুল বারি : ৪/৩১২
[৫]. নিসা :১৬০-১৬১
[৬]. তাফসিরে ইবনে কাসির: ১/৫৮৪
[৭]. উমর বিন সুলাইমান আল আশকার, সুদ ও মানব সমাজের ওপর তার কুপ্রভাব: ৩১
[৮]. জামেউল বায়ান ফি তাফসিরি আয়িল কুরআন : ৩/৬৭
[৯]. আলে ইমরান : ১৩০
[১০]. বাকারা : ২৭৫
[১১]. বাকারা : ২৭৬
[১২]. বাকারা : ২৭৮-২৭৯
[১৩]. ফাতহুল বারি : ৪/৩১৪
[১৪]. আলে উমরান : ১৩০
[১৫]. নিসা : ১৬১
[১৬]. রুম : ৩৯
[১৭]. মুসলিম : ৭৫৯৭
[১৮]. বুখারি : ২০৮৫, ফাতহুল বারি : ৪/৩১৩
[১৯]. বুখারি : ২০১৫, মুসলিম : ৮৯
[২০]. ইবনে মাজা : ২২৭৯। আলবানি সহি জামে সগিরে ৫/১২০ বলেছেন, এটি সহি হাদিস।
[২১]. আবু দাউদ : ৩৩৩৪
[২২]. আওনুল মাবুদ বি শরহি সুনানে আবি দাউদ : ৯/১৮৩
[২৩]. বুখারি : ২০৮৩
[২৪]. ফাতহুল বারি : ৪/২৯৭
[২৫]. বুখারি : ২২২৮
[২৬]. মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/৩৭
[২৭]. মুসনাদে আহমদ : ৫/২২৫
[২৮]. মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/৩৭
[২৯]. বুখারি : ২১৭৭, মুসলিম : ১৫৮৪
[৩০]. মুসলিম : ১৫৮৫
[৩১]. মুসলিম : ১৫৮৪
[৩২]. মুসলিম : ১৫৯২
[৩৩]. মুসলিম : ১৫৮৭, শরহুন নাবাবি ১১/১৪
[৩৪]. মুসলিম : ১৫৮৭, দেখুন শরহুন নাবাবি : ১১/১৪
[৩৫]. সুনানে আবি দাউদ : ৩৩৪৯, আউনুল মাবুদ : ৩/১৯৮
[৩৬]. শরহুন নাবাবি : ১১/২০
[৩৭]. এক প্রকারের উন্নত জাতের খেজুর।
[৩৮]. এক ধরনের অনুন্নত জাতের খেজুর। কেউ ব্যাখ্যা করেছেন, কাঁচা-পাকা মিশ্রিত খেজুর।
[৩৯]. মুসলিম : ১৫৯৩
[৪০]. বুখারি : ২২০২, মুসলিম : ১৫৯৪
[৪১]. মুসলিম : ১৫৯৫
[৪২]. মুসলিম : ১৫৯১, শরহুন নাবাবি : ১১/১৭
[৪৩]. মুসলিম : ১৫৯১, শরহুন নাবাবি : ১১/১৮
[৪৪]. শরহুন নাবাবি : ১১/০৯
[৪৫]. শরহুন নাবাবি : ১১/০৯
[৪৬]. ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া : ২০/৩৪৭, আশ শারহুল কাবির : ১২/১১, শরহুয যারাখশি : ৩/৪১৪
[৪৭]. শরহুন নাবাবি : ১১/০৯
[৪৮]. আল মুগনি : ৬/৫১
[৪৯]. মুগনি লি ইবনে কুদামা : ৬/৫৩, নাইলুল আওতার : ৬/৩৪৬-৩৫৮
[৫০]. তাফসিরে মানার : ৪/১২৪
[৫১]. মুসলিম : ১৫৯৬, শারহুন নাবাবি : ১১/২৫
[৫২]. বুখারি : ২১৭৯ এবং ২১৭৯, ফাতহুল বারি : ৪/৩৮১
[৫৩]. শারহুন নাবাবি : ১১/২৫
[৫৪]. ফাতহুল বারি : ৪/৩৮২
[৫৫]. আউনুল মাবুদ : ৯/৩৩৬
[৫৬]. আবু দাউদ : ৩৪৬২, আউনুল মাবুদ : ৯/৩৩৫
[৫৭]. দেখুন মুসনাদে ইমাম আহমদ : ২/৮৪
[৫৮]. বুখারি : ০১, মুসলিম : ১৯০৭
[৫৯]. নাইলুল আওতার : ৬/৩৬৩
[৬০]. শারহুন নাবাবি : ১১/০৯
[৬১]. মুসনাদে আহমদ : ২/২১৬, আবু দাউদ : ৩৩৫৭
[৬২]. মুসলিম : ১৬০২, শরহুন নাবাবি : ১১/৩৯
[৬৩]. শরহুন নাবাবি : ১১/৩৯
[৬৪]. শরহুন নাবাবি : ১১/৩৯
[৬৫]. চারটি হাদিসই দেখুন ফাতহুল বারি : ৪/৪১৯
[৬৬]. শারহুয যারকানি আলা মুযাত্তা : ৩/২৮৪
[৬৭]. মুয়াত্তা ইমাম মালেক : ২/৬৩৮
[৬৮]. বুখারি : ২১৭৪, মুসলিম : ১৫৮৬
[৬৯]. শরহুন নাবাবি : ১১/১৩
[৭০]. বুখারি : ২১৮০, মুসলিম : ১৫৮৯
[৭১]. বুখারি : ২১৮২
[৭২]. বুখারি : ২১৮১, যারকানি, শরহুল মুয়াত্তা : ৩/২৮২
[৭৩]. বুখারি : ৫২, মুসলিম : ১৫৯৯
[৭৪]. বুখারি : ০১, মুসলিম : ১৯০৭
[৭৫]. মুয়াত্তা মালেক : ৩/৯০৩
[৭৬]. বুখারি : ১৩, মুসলিম : ৪৫
[৭৭]. ইবনে মাজাহ : ৪১০২, ইমাম নাববি বলেন, ইবনে মাজা র. এ হাদিসটি হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন। শরহুন নাববি ১১/২৮
[৭৮]. শরহুন নাববি : ১১/২৮
[৭৯]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৭৯-৩৮০, সৌদি শীর্ষ আলেমদের গবেষণা অভিসন্দর্ভ : ১/৩০-৫৮
[৮০]. আবু দাউদ : ৩৫০৩, তিরমিযি : ১২৩২, নাসায়ি : ২৮৯
[৮১] আবু দাউদ : ৩৫০৪, তিরমিযি : ১২৩৪, নাসায়ি : ৪৬১১
[৮২]. আবু দাউদ : ৩৪৯৯
[৮৩]. বৃখারি : ২১৩১
[৮৪]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৮৩-৩৮৪
[৮৫]. বুখারি : ৪৫৬, ফতোয়া : সৌদি শীর্ষ আলেমদের ফতোয়া সংকলন : ২/৩৮৬
[৮৬]. বুখারি : ২২০১, মুসলিম : ১৫৯৪
[৮৭]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৮৯ আর হাদিসদ্বয়ের প্রাগুক্ত।
[৮৮]. বাকারা : ২৮২, ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৫২
[৮৯]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৯০
[৯০]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৫৩
[৯১]. ইসলামি ফাতাওয়া সংকলন : ২/৩৯০
[৯২]. বাকারা : ২৭৫
[৯৩]. বাকারা : ২৭৬
[৯৪]. বাকারা : ২৭৮
[৯৫]. বাকারা : ২৮০
[৯৬]. মায়িদা : ০২
[৯৭]. আনআম: ১১৯
[৯৮]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৯৭
[৯৯]. মায়িদা : ০২
[১০০]. মুসলিম : ১৫৯৭
[১০১]. বাকারা : ২৭৫-২৭৬
[১০২]. বাকারা : ২৭৮-২৭৯
[১০৩]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৯৯-৪০০
[১০৪]. প্রাগুক্ত : ২/৪০১
[১০৫]. প্রাগুক্ত : ২/৪০৪
[১০৬]. প্রাগুক্ত : ২/৪১২
[১০৭]. মুসলিম : ১৬০০
[১০৮]. বুখারি : ২৩০৬
[১০৯]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৪১৪
[১১০]. আবু দাউদ : ৩৩৪৫, নাসায়ি : ৫০-৫২
[১১১]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৪১৪-৪১৫
[১১২]. বাকারা : ১৯৫
[১১৩]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৪১৫-৪১৬
[১১৪]. মুসলিম : ১৫১৩
[১১৫]. মায়িদা : ৯০
[১১৬].
[১১৭]. সৌদি শীর্ষ আলেমদের ফতোয়া সংকলন : ফতোয়া : ৩২৪৯
[১১৮]. ড. উমর বিন আব্দুল আজিজ, ইসলামি দৃষ্টিকোণে সুদ এবং অর্থনৈতিক লেনদেন। পৃষ্ঠা : ৪২৫
[১১৯]. মায়িদা : ০২
[১২০]. বুখারি : ৪৮১, মুসলিম : ২৫৮৫
[১২১]. বুখারি : ৬০১১, মুসলিম : ২৫৮৬
[১২২]. নিসা : ১৬১
[১২৩]. বাকারা : ২৭৫
[১২৪]. বাকারা : ২৭৬
[১২৫]. মুসনাদে আহমদ : ৪২৪
[১২৬]. বাকারা : ২৭৮-২৭৯
[১২৭]. আলে ইমরান : ১৩০-১৩২
[১২৮]. মুসলিম : ১৫৯৭
[১২৯]. বুখারি : ২০৮৫
[১৩০]. বুখারি : ২৬১৫, মুসলিম : ৮৯
[১৩১]. মুসতাদরাকে হাকেম : ২/৩৭
[১৩২]. মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/৩৭
[১৩৩]. নূর : ৬৩
[১৩৪]. নিসা : ১৪
[১৩৫]. আহযাব : ৩৬
[১৩৬]. জিন : ২৩
[১৩৭]. বাকারা : ২৭৫
[১৩৮]. মুসলিম : ১০১৪
[১৩৯]. মুতাফ্‌ফিফিন : ১৪
[১৪০]. বুখারি : ৫২, মুসলিম : ১৫৯৯
[১৪১]. নিসা : ১৬০-১৬১
[১৪২]. ইবরাহিম : ৪২-৪৩
[১৪৩]. মুসলিম : ২৬৯৯
[১৪৪]. বুখারি : ২৪৪২, মুসলিম : ২৫৮০
[১৪৫]. মুসলিম : ৩০০৬
[১৪৬]. আবু দাউদ : ৪৯৪২, তিনমিযি : ১৯২৩
[১৪৭]. বুখারি : ৭৩৭৬, মুসলিম : ২৩১৯
[১৪৮]. আবু দাউদ : ১৯৪১, তিরমিযি : ৯২৪
[১৪৯]. তাওযিহুল আহকাম ফি বুলুগিল মারাম : ৪/০৭
___________________________________________________________________

লেখক : সায়ীদ বিন আলী বিন ওয়াহাফ আল-কাহতানি
تأليف : سعيد بن علي بن وهف القحطاني
অনুবাদ : আলী হাসান তৈয়ব
تأليف : علي حسن طيب
সম্পাদনা : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
مراجعة : عبد الله شهيد عبد الرحمن
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة بمدينة الرياض


No comments:

Post a Comment